মোজাফফর হোসেন:
যখনই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে তখনই আমরা ধর্ষককে এড়িয়ে কতগুলো উপবিষয় উত্থাপন করি। মানে বোঝাতে চাই ধর্ষক একটা পরিস্থিতির ভেতর ধর্ষণ করেছে। পরিস্থিতিগুলো কী হতে পারে?
নারীর পোশাকের কথা বলা হয়েছে।
মাদকের কথা বলা হয়েছে।
নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাবের কথা বলা হয়েছে।
এবার বেশি বলা হচ্ছে, ব্রথেলের অভাব।
কেউ কেউ বলছেন, ইন্টারনেট থেকে পর্ণো সাইট বন্ধ করা জরুরি।

এক. নারীর পোশাকের প্রশ্ন আসে না। কারণ তিন মাসের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধও ধর্ষণের শিকার হোন। আবার বোরকা পরা নারীরাও ধর্ষণের শিকার হন।
দুই. মাদকের প্রশ্ন আসে না। কারণ দেখা যাবে অধিকাংশ ধর্ষক মাদকসেবী না। কোনো কোনো ধর্ষক মাদক সেবন করতে পারে। সে যে মাদক না নিলে ধর্ষণ করতো না, সে কথা বলা যাচ্ছে না, যেহেতু অনেকে মাদক জীবনে ছুঁয়ে না দেখলেও ধর্ষণ ও হত্যা করেছে। মাদরাসার কোনো শিক্ষক মাদক নেন বলে শুনিনি, কিন্তু ধর্ষকের ভূমিকায় বরাবরই তারা আছে।
তিন. নৈতিক শিক্ষার অভাব আমি মনে করি না। প্রতিটা ধর্ষক একথা জানে যে ধর্ষণ করা ঠিক না। এটুকু নৈতিক শিক্ষা তাদের আছে। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ছাত্র যখন ধর্ষণ করে তখন আমি কী করে বলি তাদের কেউ কোনোদিন নৈতিক শিক্ষা দেয়নি! তারা কি জঙ্গল থেকে সরাসরি মানব সমাজে এসেছে? যখন কোনো মাদরাসার শিক্ষক ধর্ষণ করে তখন কী করে বলি আমার চেয়ে তার ধর্মীয় শিক্ষার অভাব আছে?
চার. সবখানে ব্রথেল থাকলে ধর্ষণ যে খুব কমবে তাও মনে করি না। যে লোকটা ছ মাস থেকে দশ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে, তার জন্য ব্রথেল থেকে লাভ কী? মাদরাসার শিক্ষক কি কোনো ব্রথেলে যাবে? যে ছেলেশিশু, মেয়েশিশু, বৃদ্ধনারী, এমন কি গরুছাগল পেলেও ছাড়ে না, তার জন্য আবার ব্রথেল কী? আর তাছাড়া যে শহরে স্বীকৃত ব্রথেল আছে, সেখানেও নিয়মিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।
পাঁচ. বাসের ড্রাইভার থেকে মাদরাসার শিক্ষক কেউ ইন্টারনেটে পর্নো দেখে ধর্ষণ করে না। ইন্টারনেট আসার আগেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এখনও যারা ধর্ষকের ভূমিকায় আছে অধিকাংশ ইন্টারনেটে পর্নো দেখার সক্ষমতা রাখে না, মানে তাদের বাসায় ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার নেই।
আমি মনে করি, যারা পর্নো ভিডিও দেখে, তাদের ভেতর কেউ যদি ধর্ষণ করে, তবে সে পর্নো দেখেছে বলে তা করছে না, সে ধর্ষক বলেই ধর্ষণ করছে। পর্নোগ্রাফি অতিরিক্ত দেখলে স্বাভাবিক যৌনতার প্রতি আকর্ষণ কমে। অর্থাৎ পর্নোআসক্ত পুরুষ বাস্তবের নারী শরীরে আকর্ষণ পায় না। তারা ফ্যান্টাসির ভেতর থাকে। এবং অধিকাংশ সময় স্বমেহন করে। বউ থাকলেও পর্নোভিডিও অন করে স্বমেহন করে। এ নিয়ে হলিউডে মুভিও আছে।
পর্নোগ্রাফি যারা দেখে তারা সঙ্গীর কাছ থেকে অতিরিক্ত রেসপন্স আশা করে, যেটা ধর্ষণের সময় কোনো নারীর কাছ থেকে কোনোভাবেই অর্জন করা সম্ভব নয়, ফলে পর্নো যে দেখে সে ধর্ষক না হলে ধর্ষণ করতে যাবে না।
কাজেই ধর্ষককে এড়িয়ে এসব পরিস্থিতির কথা বলে কোনো লাভ নেই। ধর্ষক অপরাধী। তার অপরাধ ঢাকার কোনো কারণ নেই। অপরাধ ঢাকার যে মানসিকতা সেটা দূর করতে হবে। ঘরে তালা ছিল না বলে লোকটি চুরি করলো, এ কথা বলার দিন গত হয়েছে। ধর্ষক কেন ধর্ষণ করছে সেটা তাকে জিজ্ঞাসা করা হোক।
কোনো ধর্ষক নিজে কি বলেছে কখনো যে সে নৈতিক শিক্ষা ছিল না বলে কিংবা পর্নো দেখে বলে, কিংবা বাড়ির পাশে ব্রথেল ছিল না বলে অথবা ৬ বছরের শিশুর খাটো পোশাকে উত্তেজিত হয়ে ধর্ষণ করেছে??? তাহলে আমরা আগ বাড়িয়ে এটা ভেবে নিচ্ছি কেন? ব্যক্তি ধর্ষককে আড়াল করার এই হীন চেষ্টা কেন?
আমরা সকলে চাই, ধর্ষকের কঠোর শাস্তি হোক। কিন্তু সমাজে আর সব অপরাধের শাস্তি না হলে শুধু ধর্ষণের কারণে শাস্তি হবে এটা ভাবা ভুল। যখন খুনের, ঘুষের, জালিয়াতির, ঋণখেলাপির, মাদক ব্যবসায়ীর, অপহরণকারীর শাস্তি ঠিকমতো হয় না, সেখানে ধর্ষকের শাস্তি কেন হবে?
কত লক্ষ মামলা পড়ে আছে অমীমাংসিত, তার হিসাব কি আমরা জানি? সমাজ এখন মোটাদাগে অপরাধ প্রবণ, অপরাধের পৃষ্ঠপোষক, গোটা সমাজ মূলে থেকে না বদলালে একা ধর্ষকের কেন নৈতিকতাবোধ জেগে উঠবে, আর একটা পুলিশ কেন ঘুষ নেওয়া ছেড়ে দেবে?