শায়লা হক তানজু:
প্রতিদিন নিউজফিডের পাতা ভরে থাকে ধর্ষণ, ধর্ষণ আর ধর্ষণের সংবাদে। ব্যপারটা কি এমন যে হঠাৎ বেড়েছে! আমার তা মনে হয় না, মেয়েরা মুখ খুলছে, রিপোর্ট করছে। আগে মুখ খুলতো না বলে হয়তো মেরে ফেলতো না।
তবে আমি আজকে ধর্ষণ নিয়ে না, দরজার আড়ালে যে কান্নাগুলো সমাজ, সম্মান, পরিবার আর ধর্মের নামে চাপা পড়ে তা নিয়ে আমার ব্যথাটা জানাতে চাই। রাস্তায়, স্কুলে, অফিসে যদি যৌন হয়রানির শিকার হয় শতকরা ২০ ভাগ, তবে বাকি ৮০ ভাগই যৌন নিপীড়ন এর শিকার হয় মেয়েরা নিজ গৃহে। হা ঠিকই শুনছেন, এবং আপনারা তা জানেনও।
ঘটনা-১
ছোট্ট তুলতুলকে নানার কাছে রেখে মা চাকরিতে যেতো, নানার সাথে গ্রামের পুকুরে দাপাদাপি, মসজিদে যাওয়া, দোকানে গরম গরম রসগোল্লা খেতে যাওয়া, আর নকল করে পত্রিকা পড়ার ভাণ ধরা, গল্প শোনা এসবই ছিলো তুলতুলের শৈশব। আপাতদৃষ্টিতে কী রঙিন তাই না? অথচ রাতে নানা তাকে গল্প শোনাতে শোনাতে তার কোলে বসাতো, তার ছোট্ট শরীরটা বুঝতো না কিছুই শুধু তার খারাপ লাগতো।
এখন সে সব বোঝে, কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটা, সদ্য বিয়ে করে যার ঘরে সে এসেছে তার সাথে অন্তরঙ্গ হতে গেলেই পুরানো শৈশব সামনে এসে দাঁড়ায়। সে পারে না স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন বয়ে নিতে।
ঘটনা-২
ছোট সায়রার সাথে তার বড় বোনের বয়সের তফাত ১৭ বছর। বড় বোনের বিয়ের সময় সে হাফপ্যান্ট পরতো। বড় বোনের মেয়ে তার বছর দুয়েকের ছোট। দুলাভাই বরাবর আদর করতো। সায়রা এখন ক্লাস এইটে পড়ে, ছোট্টটি নেই, বয়ো:সন্ধিকাল পেরুচ্ছে, মা অসুস্থ, বিছানায় শয্যাশায়ী। দুলাভাই প্রায় সন্ধ্যায়ই মাকে দেখতে আসে, এসেই সায়রাকে বলে, কোলে আয়, তোকে ন্যাংটো কত কোলে নিয়েছি! তুই আমার সামনে কতবার কাপড় পাল্টেছিস, এখন আর পাল্টাস না কেন? একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে ভাতঘুম দিচ্ছিলো সায়রা, দুলাভাই তার শরীরে হাত দিতে গেলে সে ধড়মড় করে উঠে চিৎকার দিয়ে উঠে। সে পরিবারের লোকজনকে বিষয়টা জানালে উল্টা তারা তাকেই গালি দেয়! বলে যে, এটা দুলাভাই এর দুষ্টামি শ্যালিকার সাথে, সে এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছে, বোনের মেয়ে, বড় বোন দুজন তাকে নটী, বেশ্যা বলেও গালি দেয়। সেই শত্রুতা আজও মেয়েটা বয়ে বেড়াচ্ছে। তার ডিভোর্সের পর তার বোনরাই থাকে শুনিয়েছে, তার মতো চরিত্রহীন মেয়ের সংসার হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
ঘটনা-৩
পুতুল এর সমবয়সী সব কাজিন ছেলে, সে তাদের সাথে গোল্লাছুট খেলে, কানামাছি খেলে, দড়ি লাফ খেলে, ঘরের চেয়ে উঠোনে ধূলোয়, ডাংগুলি, মার্বেল আর ছাগল ছানার পিছনে দৌড়াতেই তাঁর ভালো লাগে। বয়সে বেশ বড় তার খালাতো ভাই ছোটবেলা থেকেই তাকে কোলে নিয়ে বিচ্ছিরিভাবে বুকের উপর হাত রাখতো, উরুতে হাত রাখতো, আর একটু বড় হওয়ার পর তাদের বাসায় বেড়াতে এসে রাতের বেলা তার বিছানায় চলে আসতো, পাশে নানী ঘুমাচ্ছে, তবু কী সাহস!
এটা কি সাহস? নাকি আমরা, বড়রা সম্মানের নামে তাদেরকে বাঁচিয়ে দেই বলে তাদের কোন বিকার নেই। পুতুল তার পরিবারকে জানালে তারা বলে, ‘শ্শ্, লোকে জানলে তোরই বদনাম হবে। শাস্তি হলো, ঐ ভাই এরপর আর বাসায় আসলেও রাতে থাকতে পারবে না।
ঘটনা-৪
শিমুলের বিয়ে হয়েছে পারিবারিকভাবে, বরকে বিয়ের দিন ভোরে প্রথম দেখে। অচেনা মানুষের সাথে বাসর রাত, তাই স্বামীকে সে বলে কিছু সময় দিতে, যাতে দুজনের পরিচয়টা ঘনিষ্ট হয়। বর বলে, এতো টাকার গয়না আর কাবিন দিয়ে সে তাকে কিনে নিয়েছে অপেক্ষা করার জন্যে না। বিকৃত স্যাডিস্ট লোকটার প্রিইজাক্যুলেশনের সমস্যা ছিলো। নিজের অক্ষমতা ঢাকতে সে শিমুলকে মারতো, কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে চিৎকার করতে বলতো। সে পরিবারকে জানালে সবার আগে তাদের দুজনকে পাঠানো হয় ভাসুরের কাছে, কারণ সে ডাক্তার। ডাক্তার ভাসুর তার বরকে বাইরে পাঠিয়ে দেয় আলাদা করে দুজনের সাথে কথা বলবে বলে, আর খালি রুমে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিমুলের উপর, বলে, তার ভাই যেটা তাকে দিতে পারছে না সেটা সে দিবে। বাবা-মাকে এ ঘটনার কথা জানালে বলে, এডজাস্ট করো, বলে, আমাদের পরিবারের মেয়েরা লাল কাপড়ে শ্বশুরবাড়ি যায়, সাদা কাপড়ে ফেরত আসে।
এরকম আরও অসংখ্য ও আরও মর্মান্তিক সব ঘটনায় কোটি কোটি মেয়ে হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য। তারা রোজ খুন হয় নিজের ঘরে, সবচেয়ে নিরাপদ গৃহে কখনও মামা, কখনও খালু, কখনো কাজিন, তো কখনো দাদা-নানার দ্বারাও, আবার কখনও নিজের বরের মাধ্যমে।
এই যে পরিবারগুলো এসব ঘটনায় শ্শ্শ্ বলে, লোকে কী বলবে সে ভয়ে চুপ করিয়ে দেয়, এগুলোই জন্ম দেয় নির্লজ্জ পৈশাচিক ধর্ষকদের। এগুলোর কোন রিপোর্ট হয় না। কোনো মামলা হয় না। খবরের কাগজে নিউজ হয় না। অথচ কোটি কোটি মেয়ে বড় হয় নিজের শরীরকে ঘৃণা করে, এঁটো ভেবে, নিজেকেই নিজে শত্রু ভেবে। তাদের অনেকেই পারে না বিবাহিত জীবনের স্বাভাবিক দাম্পত্য পালন করতে।
যে সমাজে রোজ রোজ পাঁচ মাসের শিশু থেকে ৫০ বছরের নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়, ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়, সেইসব ঘটনার কটা রিপোর্টই বা গণমাধ্যমে ছয় মাসের পরিসংখ্যানে উঠে আসে? যেগুলোই বা আসে, অধিকাংশেরই তো বিচার হয় না। আর সেখানে আমার উপরিল্লিখিত ঘটনাগুলো তো রীতিমতোন ডালভাত। এসব আবার কথা বলার মতো বিষয় নাকি? ঠিকঠাক মতো পর্দা করলে এসব হতো না।
‘মেয়েমানুষ’, যদিও পাঁচ বছরের শিশু, তারপরও কেন বাইরে বেটাছেলেদের সাথে মার্বেল খেলবে, কেন এতো মিশবে ছেলেদের সাথে, কেন এতো হাসবে হোক না তা মামা- চাচা, দাদা- নানার সাথে, যাকগে যা হওয়ার হয়েছে, এর জন্যে আত্মীয়র সাথে সম্পর্ক তো ভাঙ্গা যাবে না!
আর লোকে জানলে কে বিয়ে করবে এই মেয়েকে, সমাজে মুখ দেখাবে কী করে? থু থু দিবে লোকে। কিন্তু কত কত মেয়ে জীবন্মৃত হয়ে শুধু সামাজিকতার দায়, পরিবারের সম্মানের দায় মেটানোর জন্যে বেঁচে থাকে খুন হয়ে যাওয়া শৈশব নিয়ে, সেটা নিয়ে আর কতকাল চুপ থাকবে এই সমাজ?