শীলা চক্রবর্ত্তী:
কথাটা তো নতুন কিছু নয়! ছোটো থেকেই শুনে আসছি, লালবাতির মেয়েরা আছেন বলেই ঘরের মা বোনদের “ইজ্জত” নিরাপদ আছে! বীরপুঙ্গবদের যাবতীয় শখ-শৌখিনতার দায়-টায় তাঁরা শরীর পেতে নিচ্ছেন বলেই ঘরের মেয়েরা নিরাপদে আছে, শেয়াল শকুনে নাকি টেনে নিয়ে যেতো তা না হলে!
এই কথাটাই তো একটু ঘুরিয়ে বলা হচ্ছে, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে নাকি বেশি বেশি করে লালবাতি এলাকা সৃষ্টি করতে হবে! চমৎকার দাওয়াই! সভ্যতার বুকের দগদগে ঘা নারী শরীর নিয়ে ব্যবসা, তার পরিসর বাড়াতে হবে, কেননা সমাজে ধর্ষক বেড়ে চলেছে, তাই তাদের চাহিদা মতো “জোগান” দিতে এগিয়ে আসতে হবে! এই না হলে সভ্যতা!
তা ধর্ষণের বিকল্প কী করে অর্থের বিনিময়ে শরীর ভোগ হতে পারে? ধর্ষণ কি শুধু নারী শরীর ভোগ মাত্র?
ধর্ষণ এক সুপ্রাচীন লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতি, যা কেবল নারীর শরীর নয়, তার সম্মতির বিরুদ্ধে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং আত্মমর্যাদার হানি করবার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসা ঘৃণ্য অস্ত্র !! অন্তত ধর্ষকরা এই মানসিকতা থেকেই ধর্ষণ করে , শরীর সেখানে একটি মাধ্যম মাত্র । লালবাতির মেয়েদের সাথে অর্থের বিনিময়ে সম্ভোগ করলে সেই উগ্র প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয় নাকি ??
ধর্ষণের কতোগুলো রকমফের আমরা অদূর অতীতে দেখেছি ?? শিক্ষামূলক ধর্ষণ – মনে পড়ে জ্যোতি সিংহ নির্ভয়াকে ?? গণধর্ষণকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত মুকেশ সিং বলেছিলো, মেয়েটিকে শিক্ষা দিতেই ধর্ষণ করা হয়েছে । কেননা সে বাড়ির লোক ছাড়া একা একা রাতের বেলা পথে বেরিয়েছে, কেননা সে পুরুষবন্ধুর সাথে সিনেমায় গেছে, কেননা এতো রাতে কোনো “ভালো মেয়ে” অনাত্মীয় যুবকের সাথে বাড়ির বাইরে থাকে না …… না, এইগুলো আইন বা সংবিধান ঠিক করে দেয়নি, তারা আপনি মোড়ল হয়েই এসব ঠিক করে নিয়েছে, দায়িত্ব নিয়ে । ভালো মেয়ে মন্দ মেয়ের মাপকাঠি । মেয়ে একা রাতে বাইরে বেরোয় ? ধর্ষণ করো !! মেয়ে বয়ফ্রেণ্ড নিয়ে ঘোরে ?? ধর্ষণ করো !! মেয়ে নাইটক্লাবে যায় ?? ধর্ষণ করো !! মেয়ে মুখে মুখে চোপা করে ?? ধর্ষণ করো !! মেয়ের জামার ঝুল পছন্দ হচ্ছেনা ?? ধর্ষণ করো !! কতোসব সুবিধেজনক দাওয়াই, শিক্ষামূলক ধর্ষণের !! লালবাতির অসহায় মেয়েগুলো তো বিকিয়েই আছে, ওদের ধর্ষণ করলে এই “শিক্ষামূলক সামাজিক উপকারের যে আনন্দ” , সেটা কোত্থেকে আসবে ?? দুটো বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা, মূর্খের সপ্তস্বর্গে বাসকারীরা ভেবে দেখবেন ??
একটি ঘৃণ্য ইংরাজি প্রবাদ আছে, “when rape is inevitable, enjoy it”! ধর্ষণ যখন অনিবার্য, তখন তা উপভোগ করো। এইগুলো নতুন কিছু নয়, প্রাচ্য হোক কী প্রতীচ্য, পূর্ব হোক কী পশ্চিম, ইতরামিকে জাস্টিফাই করবার ঢালাও আয়োজন সমস্ত প্রতিবেশ জুড়ে। সেখানে এইসব দাওয়াইয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হবার ক্ষমতা আমাদের এতোদিনে লোপ পেয়ে যাবার কথা!
আইন বলছে, একজন যৌনকর্মিকেও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করা যাবে না, যতোই তুমি টাকা দাও না কেন! অথচ ধর্ষণের শিকার মেয়েকে অনায়াসে ‘বেশ্যা’র তকমা দিয়ে ধর্ষণকে জাস্টিফাই করবার নোংরা চাতুর্য উপর্যুপরি ঘটেই চলেছে!
কলকাতার পার্কস্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে সুজেট জর্ডনের ঘটনা মনে করে দেখুন! সুতরাং ধর্ষণের বিকল্প হিসেবে বেশ্যাগমনকে দাগিয়ে দেয়া মাননীয়দের নৈতিক কর্তব্যের মধ্যেই তো পড়ছে! এইসবেই তো আমরা অভ্যস্ত!
ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যধির কোনো নির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও আমাদের সমাজে এর একটি প্যাটার্ন আছে। ধর্ষণের সম্ভাব্য দায়ভারটুকু সমাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার নারীটির ওপরে চাপিয়ে দিয়েই খালাস হয়। ভিক্টিমের একঘরে হওয়া থেকে আত্মহত্যা করা, সবরকম উদাহরণই আশপাশে মজুত!!
আর ধর্ষকরা যেহেতু আমাদের সমাজের মধ্যে থেকেই উঠে আসে, তাই তারা এগুলো ভালো করেই জানে। তাই ধর্ষণের একটি অন্যতম বড় কারণ তো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাও! প্রেমে প্রত্যাখ্যান থেকে শুরু করে শরীকী ঝামেলা, সবকিছুতেই অব্যর্থ দাওয়াই, “মুখ দেখানোর মতো জায়গা ছেড়ো না”! সেইটি কী করে লালবাতির মেয়েদের সাথে শরীরী সম্ভোগে লিপ্ত হয়ে করা সম্ভব?
যারা শরীরে জেগে ওঠা কামপ্রবৃত্তি নিবৃত্ত করা আর পাশবিক নৃশংসতা চরিতার্থ করাকে আলাদা করতে পারেন না, বা অত তলিয়ে ভেবে দেখতে রাজী নন, তাদের পক্ষে এহেন দাওয়াই হেঁকে দেয়াটাই তো স্বস্তির!