দেবী গাফফার:
এগারো
একটু আগেই বাসায় ঢুকলাম। এই ভোরবেলা কোন মহিলা আসলো? রাজীব সাহেব এর চেহারা কিছুটা কঠিন হলো। জানতে চাইলাম, এতো ভোরে কে আসছেন? বললেন, সব বলবো, আমি একটু বসার ঘরে গিয়ে কথা বলে বিদায় দিয়ে আসি?
আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম, আমার এখন কী করা উচিৎ? একবার ইচ্ছা হলো, তিন তলা থেকে নেমে দৌড়াতে থাকি, অনন্তকাল দৌড়াতে থাকি। আবার ভাবছি, আমি হারবো না, হেরে যাওয়ার জন্য আমার জন্ম হয়নি। এই অগ্নিপরীক্ষা আমি পার করবোই। সকাল ৮ টার দিকে রুমে আসলেন, আমাকে সেদিন অভিনয় করতে হয়েছিলো, স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে হাসি হাসি মুখ করে বলি, মেহমান চলে গেলেন? নাস্তা দিলেন না?
আমি কিছু বলতে পারি না। ঝগড়াঝাটি দূরে থাক। আমি হেরে যাবো? আমি হারবো না। বিদায় বেলায় ভাই বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত তোমার, অনেক কিছু কানে আসবে। নিউজ হবে, ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবেলা করে সংসার করতে হবে। আমি হ্যাঁ বলেছিলাম।
রাজীব সাহেব বললেন, একসাথে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এজন্য তুমি দায়ী। দুই বছর ধরে ঘুরছি, পাত্তাই দিলা না।
বললেন, মহিলা আমাকে বিয়ে করতে চান, আমি নিজেই ক্যারিয়ার গড়তে পারিনি, উনার দুই বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা আমার হয়নি। তাছাড়া একই প্রফেশনে সংসার হয় না। উনাকে বলেছি, বিয়ে করবো না।
হেসে বলি, শুটিং আছে? বললেন, আছে। নাস্তা খাইয়ে শুটিং এর জন্য কাপড় রেডি করে দিচ্ছি, উনি বার বার বলছিলেন, দেবী, আমি তোমাকে বিয়ে করে ভুল করিনি, ভুল করিনি।
আমি রাতে ভাই এর বাসায় ফিরানিতে আসি। বাসায় হঠাৎ সবাই ফিসফিস করে কী যেন বলছে, আর কানাকানি হচ্ছে। আমি কিছুটা অবাক। মেজোমা বললেন, মি. কক্স এসেছে।
বাহ্ কাহিনি শুরু, সামলাও, দেবী সামলাও। ঠাণ্ডা মাথায় মেজোমাকে বললাম, উনি কি জানেন আমার বিয়ে হয়েছে? জানে, খুব কান্নাকাটি করছে, তুমি বিয়ে করেছো এই কথা তোমার নিজের মুখে শুনতে চায়। ওর ধারণা আমরা তোমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছি।
আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে, জিজ্ঞেস করেন, তিন মাস কোথায় ছিলো? মেজোমা বলেন, সব বলেছে, টাকা-চিঠি সব পাঠিয়েছে। ১৩ শ টাকা, চিঠি কোনটাই আমার হাতে পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি। ডাকপিয়ন? ওর ঘাড়ে মাথা কয়টা?
উনার ঐ ভাই মারা গেছেন, বেহেশত নসীব হোক। আমি ক্ষমা করেছি। গত রাতে ওই মহিলা, আজকে মি. কক্স। আল্লাহ এবার তো ক্ষান্ত দেন। আমি আর উনার সাথে দেখা করলাম না। আল্লাহ আর পরীক্ষা নিও না। রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে।

দেখা করে কী হতো? আমি তো দেখা করতে পারি না। বিয়ের অলিখিত শর্তই হলো দু’জন দুজনের বিশ্বাস ভংগ না করা।
আমি মা হতে যাচ্ছি। সবাই খুশি, কী খেতে চাই, জোর করে ডিম খাও, নাক চেপে ধরে দুধ খাও। এর মধ্যে নানান কথা কানে আসে। কিছুই জিজ্ঞেস করি না। বিয়ের দিন রাজীব সাহেব বলেছিলেন, আমি শিল্পী, মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে না পারলে আমার ক্যারিয়ার গড়তে পারবো না। আশা করবো তোমার বুদ্ধি ও সাহস দিয়ে আমার পাশে থাকবে। আমি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকবো কথা দিয়েছিলাম।
খেয়াল করলাম, শুক্রবার উনি বাসায় থাকেন না, যা বুঝার বুঝে নিলাম। মানসিক ভাবে ভেংগে পড়ি। উনাকে কিছু বুঝতে দিলাম না। উনার খাওয়া, ড্রেস, শুটিং এর টুকিটাকি সব কিছুর দায়িত্ব নিলাম। দুই বাচ্চা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা, ভালোবাসা দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা।
ওই মহিলা (ছবিতে মা’য়ের পার্ট করতেন) আমার মায়ের বয়সী। উনার কাছে খবর পাঠাই, আমি দয়া ভিক্ষা চাই। কে শোনে কার কথা, উনারও মেয়ে আছে, ওটা মনে করে হলেও যেন আমার সংসার থেকে সরে যান, আমার তো কোন অপরাধ নাই! পরবর্তীতে রাজীব সাহেব নিজেই সরে আসছিলেন। উনিও তো একজন মহিলা ছিলেন! একজন মা ছিলেন! মফস্বল এর সহজ সরল মেয়েটার প্রতি উনার কোন দয়া আসেনি? রাজীব সাহেব পুরুষ মানুষ, তাকে ভোলানো সহজ। কিন্তু উনি? ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেও উনার ভিতরে মা কাকে বলে এই বোধগম্যতা হয়েছিলো কি?
উনাকে আমি ক্ষমা করেছি। এখন চোখে ছানি, বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন, জনগণের সাহায্যে চিকিৎসা হয়। উনার মেয়ের বিয়েতে ৩০ হাজার টাকা আমি সাহায্য করেছিলাম রাজীব সাহেব এর হাত দিয়ে।
এতোকথা বলার কারণ হলো, যখন কোন সংসারে পরকীয়া ছোবল মারে, তখন ভুক্তভোগী মানুষগুলো তিলে তিলে মরে। যারা করে কর্মফল কী হবে একবারও কি ভাবে? যে যতই চেষ্টা করুক, আমার জায়গা, আমার সম্মান নিতে পারেনি। রাজীব সাহেব বলতেন, সোনা পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়। তুমি খাঁটি সোনা। রাজীব সাহেব, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি বেহেশতবাসী হোন।
আমি জমজ সন্তান এর মা হলাম। আমাদের সুখ উপচে পড়লো। জয়-বিজয়কে নিয়ে উনার স্বপ্ন দৌড়াতে থাকে। রাজীব সাহেব এর পাশে থেকে উনার কাজকে উৎসাহিত করে এগোতে থাকলাম, ১০ হাজার টাকা প্রতি ছবিতে পেতেন। আউটডোর শুটিং এ নায়ক-নায়িকা প্লেনে যেতো, বাকিদের বাসে পাঠানো হতো। আমার কাছে দুঃখ করে বলতেন, এমনকি কোনদিন আসবে না, যেদিন আমাকেও প্লেনে পাঠাবে! আমি বলতাম, পাঠাবে।
সেইদিন আসলো, ১০ হাজার টাকা থেকে প্রতি ছবির জন্য সাড়ে চার লাখ টাকা হলো। বছরে ৩৩ ছবি রিলিজ হচ্ছে।
বাসায় চারজন কাজের লোক, নতুন আসবাব।
বড্ড সরল মানুষ ছিলেন।
একদিন ডিসেম্বর মাসের সকাল, একসাথে শুটিংয়ে যাবেন, আনু ভাই আসলেন (আনোয়ার হোসেন)। দেবী, আনু ভাইকে কী খাওয়াবা? ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি দাও। আমি আর আনু ভাই হেসে ফেলি (আগের দিনই আমাদর বাসায় প্রথম ফ্রিজ আসে)।
ভাইদের একজন একজন করে আমার বাসায় নিয়ে আসলাম। একভাই সৌদি গেলো, দুই ভাই সিংগাপুর।
কক্সবাজারের আগের বাড়ি ভাংগা হলো, ভাইবোন মিলে নতুন করে চার রুমের বাড়ি করলাম। বাড়িতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলো।
আমারও একটা বাড়ি দরকার, সারাদিন উত্তরায় বাড়ি খুঁজি, মন মতো বা সামর্থ মতো হয় না। একদিন ৯৫ সালের জুন মাস বাড়ি পেয়ে যাই। বড় বড় রুম, দুইতলা বাড়ি ১ নম্বর সেক্টর এ। কিনে ফেলি, আমার জমানো যা ছিলো দিলাম। স্বপ্নের বাড়ি হলো।
বাচ্চাদের বয়স নয় বছর এর মতো, অক্সফোর্ড স্কুলে ক্লাস ফোর এ পড়ে। ভালো রেজাল্ট করে। এখন স্কুল কী হবে? এতোদূর ধানমন্ডি পাঠানো যাবে না। বাসায় টিচার রাখা হলো।
দুইদিন আগে একটা দাওয়াত ছিলো, যাবো কথা দিয়েছিলাম, নতুন বাসায় সংসার গোছানো, তিন ছেলে সামলানো, আমি একা, দাওয়াতে যাওয়া হয়নি, পরের দিন সকালেই যার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত ছিলো সে হাজির, বিলাপ করে কান্না।
মেয়েটা ছিলো আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, একসাথে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। হাসব্যান্ড এর সাথে ডিভোর্স হ’য়ে যায়। আমার বাসায় আশ্রয় দিলাম, ছোটবেলায় একসাথে পড়েছি, কখনও অসম্মান করিনি। আলাদা রুম দেওয়া হলো, তার কাজ ছিলো বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া।
কাঁচপুর ব্রিজ এর কাছে এক ছেলের সাথে প্রেম করে। নিজের পরিচয় দেয় রাজীব সাহেব এর শালী। আমি কিচ্ছু জানি না। ভেগে বিয়ে করে। রাজীব সাহেব এর শালী শুনে ছেলের বাড়ি মেনেও নেয়। আমিও ভাবি, আহা বেচারি সুখী হোক, আমাদের নাম দিয়ে যদি কারও সংসার হয়, ঠিকানা হয়, ক্ষতি কী?
বললো, তোরা না গেলে আমার বিয়ে ভেংগে যাবে, গরু-ছাগল কেনা হয়ে গেছে, রাজীব সাহেব এর সিডিউল নাই, আমি বাড়ি ঘরের এই অবস্থা রেখে যেতে পারি না। কী করি! ও বললো, জয়-বিজয় কে দে, ওদের দেখলে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিশ্বাস করবে আমি তোর বোন।
মনে মনে বলি, আহা আমিও তো গরীব ছিলাম, বাচ্চাদের একদিনের জন্য যাওয়া যদি কারও সুখের কারণ হয়, যাক না! রাজীব সাহেবকে ফোন দিয়ে সব বলি। বললেন পাঠাও, কালকে সকালেই যেন চলে আসে।
আমার বাচ্চারা হাসতে হাসতে গেলো,পরের দিন লাশ হয়ে ফিরলো। আমার বাবুরা। আমি কেমন করে বাঁচবো? কী নিয়ে বাঁচবো? অন্যের উপকার করতে গিয়ে আমার জানের টুকরাদের হারালাম, নয় বছরের প্রতিটি মুহূর্ত কেমন করে ভুলবো? আমার সাজানো সংসার, কত সাধনায় গড়া স্বপ্ন মুহূর্তে খান খান হয়ে গেলো।
আমার বেঁচে থাকার আর কোন ইচ্ছাই রইলো না। মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকি।
”বার”
জয়-বিজয় চলে গেলো আমি একা হয়ে গেলাম, আমার পৃথিবীর সব আনন্দ ওরা নিয়ে গেলো। রাজীব সাহেব এর কান্না কে থামাবে? আমি ছাড়া তার কে আছে? নিজের হাহাকার এক পাশে সরিয়ে রেখে উনার হাল ধরলাম। দিনের পর দিন আমার ঘুম নাই, চোখ বন্ধ করলেই মা মা ডাক কানে আসে। সেই থেকে আজ-ও আমি সারারাত জেগে থাকি।
বাচ্চা হারানো একজন মায়ের কেমন লাগে এটা রাজীব সাহেব বুঝেছিলেন কিনা আমি জানি না। কাঁদতেন আর বলতেন, সব দোষ তোমার, যেহেতু ওই মহিলা আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আমি আমার তুফান আড়াল করে, মায়ের মতো, বন্ধুর মতো উনার হাত ধরে রাখি। আমার যাই হোক, আমি রাজীব সাহেবকে একা হতে দিইনি। বিয়েতে দেওয়া ওয়াদা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।
উনাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে আমি চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি করে একবেলা কাঁদতেও পারিনি। আমার অসহায় লাগলে রাস্তায় নেমে জোরে দৌড়াতে ইচ্ছে করে, সেই অনন্তকালের দৌড়, যতক্ষণ হুঁশ থাকবে আমি সেই দৌড়টুকুও দিতে পারিনি। আমার পাশে কেউ ছিলো না।
একদিন আমার মা খেয়াল করেন, আমি গভীর রাতে ছাদে একা বসে থাকি, গাছের সাথে কথা বলি। ছোট বাচ্চাটার খবরও রাখি না, আমার তৃতীয় ছেলে দীপ। আমার বলতে কিছুই রইলো না। এই নতুন বাড়ি কেনার বয়স মাত্র ১৬দিন। বাড়ি দিয়ে আমি কী করবো, আমি কেমন করে বাঁচবো? রাজীব সাহেব এর কমপ্লেনও থামলো না, কান্নাও থামলো না।
আমি কোথায় যাবো? রাজীব সাহেব যেমন সন্তান হারিয়েছেন, আমিও তো হারিয়েছি, আমার মাথায় কে হাত রেখে বলবে, আমি তো আছি।
আমি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি, কাউকে বুঝতে না দিয়ে। আমি উনাকে খাওয়াচ্ছি, ঘুম পাড়াচ্ছি। আমি তো আমার মধ্যে নেই। আমি উনাকে ক্ষমা করেছি। আমার কোন অভিযোগ নেই। সবাই সব পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না, হয়তো উনিও পারেননি।
হয়তো উনার ধারণা, দেবী সহনশীল, নিজেকে সামাল দিতে পারবে, একাই পারবে। আমিও আমাকে সামাল দেওয়ার একাই চেষ্টা করেছিলাম। করতে হয়েছে।
উনি সবকিছুতেই আমার ওপর ভরসা করতেন। আমি যেন মা, উনি অবুঝ সন্তান। আমি একা জিন্দা লাশ হয়ে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে থাকি। জীবনের সমস্ত কষ্ট ভুলে, কলিজার ভিতরে সারাক্ষণ মা মা ডাক শুনতে থাকি। এখনও শুনি। কোথাও গেলে সবাই যখন জানতে চায়, বলেন তো জয়-বিজয় কীভাবে মারা গেলো? সাথে সাথে আমার ভিতরে সন্তানহারা মা জেগে ওঠে, দম বন্ধ হয়ে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে, সেই মা মা ডাক কানে বাজতে থাকে। অনেক কষ্টে আস্তে করে বলি। অন্য দিন বলি?
আমার এতো পাওয়া, গাড়ি বাড়ি টাকা গয়না কোনকিছুরই আর মূল্য রইলো না। আমার সাজানো সংসার শেষ হয়ে গেলো। মনের শান্তির জন্য হজ করতে গেলাম, শান্তি কই? মায়েরা বুঝি এমনই হয়! বাচ্চা হারায়ে ফেললে কোথাও শান্তি পাওয়া যায় না।
দিন চলে যায় তার মতো। আট বছর পর।
কিছুদিন থেকে রাজীব সাহেব এর পেটে হালকা ব্যথা। ডাক্তার দেখালেন, তিন মাস ওষুধ খেলেন, হালকা ব্যথা কমে না। তিনমাস পর আবার ডাক্তার দেখালেন,পেটে টিউমার। পরের দিন বোম্বে (মুম্বাই) রওয়ানা দিলাম। ঘর-বাড়ি, বাচ্চা, সব কাজের লোকের কাছে রেখে রওয়ানা দিলাম। অপারেশন করতে হলো। এখন বায়োপসি রিপোর্ট এর অপেক্ষা। রিপোর্ট আসলো ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। ওরাল কেমো শুরু হলো, এক নাগাড়ে দুই মাস। দুই ঘন্টা পর পর খাবার দিতে হয়, দুই মাস কেটে গেলো। ঢাকা আসলাম, সুস্থ আর হলেন না।
সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, আবার বোম্বে, নয় মাস কেটে গেলো। এই নয় মাস আমি এক ঘন্টার বেশি ঘুমাইনি। আমি ছাড়া কিছু বুঝতেন না। এক মুহূর্ত সরতে দিতেন না। চিকিৎসা চলার সময় কোটি টাকা খরচ হয়ে গেলো, হাতে আর টাকা নাই।
সবাই বললেন, পেপার, টিভিতে সাহায্যের আবেদন করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি, অনেক কথা হয়। ম্যাডাম দুই লাখ টাকা দিলেন। বললাম, ম্যাডাম এই টাকায় হবে না। উনি বলেছিলেন, পেপারে টিভিতে সাহায্যের আবেদন করে দাও। সেদিন মন ভারাক্রান্ত হয়েছিলো। যে মানুষটা এতো দান করেছেন, তার চিকিৎসা করাবো ভিক্ষা করে? যে লোকটা কোটি টাকা দলের জন্য খরচ করেছেন, লক্ষ মানুষকে সাহায্য করেছেন, তার চিকিৎসা আমি ভিক্ষা করে করাবো না। ঐ দুই লাখ টাকা আমি নিতে চাইনি। রাজীব সাহেব এর অনুরোধে রাখি। এক রাতের সিদ্ধান্তে আশুলিয়ার মেইন রোডের সাথে জায়গা অর্ধেক দামে বিক্রি করে পরের দিন সিংগাপুর নিয়ে যাই। আমি জীবনে না খেয়ে থেকেছি, ভিক্ষা করিনি, অনৈতিক কাজ করিনি। মিথ্যা বলিনি, এখনও বলি না।
চলে যাওয়ার আগে বারবার ক্ষমা চাইলেন। বাড়ির দলিল, যেখানে যা আছে আমার নামে গুছিয়ে দিলেন। একজন নামাজি, দানশীল, দয়াবান, শক্তিশালী অভিনেতা চলে গেলেন।
বাংলাদেশের যখন যেখানেই শুটিং, মিটিংয়ে গিয়েছেন, মসজিদের সিমেন্ট, মাইক কিনে দিয়েছেন।
এফডিসিতে এমডি থাকাকালিন অনেক লোকের চাকরি দিয়েছেন। অনেক এমপির মিটিং তো করেছেনই, টাকাও দিয়েছেন।
কষ্ট করে কামাই করা বেশির ভাগ টাকা জাসাস বাঁচিয়ে রাখার জন্য খরচ করেছেন। রাজীব সাহেব যাওয়ার পর আমার বাচ্চাদের খবর কেউ নেয়নি, আমার কথা বাদই দিলাম। রাজনৈতিক নেতারা বা ফিল্ম এর অভিনেতারা।
আমার হাতে টাকা আসার পর সব আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, সবার দুর্দিনে পাশে ছিলাম, আছি। যার জন্য যতটুকু প্রয়োজন করেছি।
রাজীব সাহেব যা দিয়ে গেছেন, বাকিটা জমির ব্যবসা করে আমি করেছি।
কিছুদিন পর বাবা আসলেন অসুস্থ হয়ে, যা পারি করলাম। চিকিৎসায় কাজ হলো না। কক্সবাজার গিয়ে আমার চাচাতো বোনের বাসায় মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে কোন সন্তানের ভালোবাসা, সেবা বাবার নসীবে জুটলো না।
জন্মের পর মেয়ে হয়েছে শুনে যার মুখও বাবা দেখতে চাননি, সেই আমি কক্সবাজার গিয়ে বাবার দাফন করি, তিনদিনের মিলাদ করি। জীবন এমনই, কাউকে ক্ষমা করে না। তিন ছেলের কাঁধে উনার লাশ উঠলো না।
আমার মা আজও ক্ষমা করেননি।
মায়ের শখ ছিলো দোতলা বাড়িতে থাকবেন। মাকে ডুপ্লেক্স বাড়ি করে দিয়েছি। ভাইরা বউ বাচ্চা নিয়ে ভালো আছে।
উত্তরা যখন বাড়ি কিনি, আমাদের পাশের বাসা গাফফার সাহেবদের। আমার বাবুরা মারা যাওয়ার পর অমি সাহেবের বাবা-মা-দাদী আমার অনেক খেয়াল রেখেছেন। আমি খেতে চাইতাম না বলে প্রতিবেলায় খেতে বসে আমার ডাক পড়তো। উনাদের ভালবাসা পেয়ে আমি আবার সুস্থ হয়ে উঠি। পরবর্তীতে ফেরেস্তা রুপি ঐ অমি গাফফার এর সাথেই আমার বিয়ে হয়। জীবন আমার, সিদ্ধান্তও আমার, আমি বিয়ে করি। আমি ধন্য যে এতোবড় ফ্যামিলিতে আমার বিয়ে হয়। মা- বাবার সব আদর শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে পাচ্ছি।
এই অমি সাহেবই ভিতরে ভিতরে মরে যাওয়া আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন। উনার চোখ দিয়ে পৃথিবীর রং রূপ দেখিয়েছেন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম পৃথিবীর সুন্দরতা। হাত ধরে নিয়ে গেছেন পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। আমার চোখের পানি মাটিতে পড়তে দেয়নি। বেঁচে থাকার মানে বুঝিয়েছেন।
আমার সারাজীবনের ভাগ্য এমন রাজ পরিবারে আমার বিয়ে হয়। ওদের বাড়ির সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের বুকভরা ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আমার শ্বশুর বাড়ির সবার কাছে কৃতজ্ঞ। অমি সাহেব এর ভালবাসা সাথে নিয়ে জয়-বিজয় এর সাথে দেখা হোক। আর কোন চাওয়া-পাওয়া নাই।
“শেষ”