‘পর্দা’ একটি ‘ভ্রাম্যমান জেলখানা’, ধর্ষণ না হওয়ার গ্যারান্টি নয়

সজীব সরকার:

মানুষ ধর্ষণ কেন করে?

এক কথায় এর জবাব দেয়া মুশকিল। মানুষ ‘প্রয়োজনে’ ধর্ষণ করে, প্রয়োজন ছাড়াও ধর্ষণ করে।

ধর্ষণ হলো নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও শক্তি প্রয়োগের একটি বিশেষ পন্থা। নারী সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভুল ধারণা ও কুসংস্কার এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে পুরুষ ধর্ষণ করে। অনেক সময় কেবল ‘নিরাপদ সুযোগ’ পেয়েছে বলেও ধর্ষণ করে। এর মাধ্যমে পুরুষ জানান দিতে চায়, নারীর চেয়ে সে শ্রেষ্ঠ, নারীর চেয়ে সে বলশালী এবং অভিযোজন বা বিবর্তনের ধারায় নারীর চেয়ে সে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।

ঘটনার চরিত্রগত কারণেই এটি স্পষ্ট, ধর্ষণ মানে একজন নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার ওপর শক্তি প্রয়োগ, তার ওপর যৌন নির্যাতন। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো নারীকে ভিকটিম হিসেবে যতোটা, তার চেয়ে বেশি ‘দোষী’ হিসেবে দেখা হয়। ধর্ষণের সময় নারীটি কোথায় ছিলো, সেখানে কেন গিয়েছিলো, ওইসময় একা ছিলো কি না, কী পোশাক পরা ছিলো… এমন অযৌক্তিক হাজারো প্রশ্নে ভিকটিমকে বিব্রত করা হয়, হেনস্তা করা হয়, দোষারোপ করা হয়।

আমাদের কিছু বিষয় বোঝা দরকার; একজন নারী কোথায় যাবে, কখন যাবে, একা যাবে নাকি সাথে ‘পাহারাদার’ নেবে, আর কী পোশাক পরবে – এগুলো একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এগুলো তার চয়েস। একজন ব্যক্তির চয়েসকে সম্মান করতে হবে।
একটি মেয়ে রাতে ঘরের বাইরে যাওয়া কি অপরাধ? আর এর শাস্তি কি তাকে ধর্ষণ করা? সেই শাস্তি প্রয়োগের মহান দায়িত্ব ধর্ষকদের কে দিয়েছে?

একা ঘরের বাইরে যাওয়া পৃথিবীর কোন আইনে অপরাধ? এটি যদি অপরাধ হয়েও থাকে, এর শাস্তি কি তাকে ধর্ষণ করা? সেই শাস্তি প্রয়োগের পবিত্র দায়িত্ব ধর্ষকদের কে দিয়েছে?

একজন নারী কী পোশাক পরবে, তা নির্ধারণ করে দেয়ার অথরিটি একজন পুরুষকে কে দিয়েছে?

আমরা দেখি, ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটলে মেয়েটির পোশাক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়; অনেক ‘উচ্চশিক্ষিত’ পুরুষ (এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক নারীরও) বিশ্বাস, তথাকথিত ছোটখাটো বা খোলামেলা পোশাক (অর্থাৎ যা ধর্মের দৃষ্টিতে ‘পর্দা’ নয়!) একটি নারীর ধর্ষিত হওয়ার কারণ; তারা বিশ্বাস করেন, ‘পর্দানশীন’ হলেই মেয়েটি ধর্ষিত হতো না বা যারা ‘পর্দানশীন’ তারা ধর্ষিত হবে না। তাদের একবার ভেবে দেখা দরকার, পর্দা বা বোরকা বা হিজাব – যে শব্দেই বলি না কেন, এমন পোশাক বা ‘পর্দা’ একটি মেয়েকে কখনোই ধর্ষিত না হওয়ার গ্যারান্টি দেয় না; দিলে আমাদের দেশে বা অন্তত মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশে শতভাগ পর্দা মেনে চলা নারীরা ধর্ষণের শিকার হতো না।

আরেকটি ব্যাপার হলো, দুই মাসের কন্যাশিশু এমনকি ছেলেশিশুও তো ধর্ষিত হচ্ছে; দুই মাসের একটি শিশুর শরীরে কী আছে যা একজন পুরুষকে উত্তেজিত করে আর তা পর্দা দিয়ে না ঢাকলে সেই উত্তেজনা ঠেকানো যায় না বলে তাকে ধর্ষণের মাধ্যমেই ওই পুরুষটিকে তার উত্তেজনা কমাতে হবে?

ধর্ষণের সাথে পোশাকের বা পর্দার কোনো সম্পর্ক নেই; ধর্ষণ রয়েছে পুরুষের মস্তিষ্কে; পুরুষকে নিজের যৌন চাহিদায় সিলেকটিভ হতে হবে, নিজের যৌন চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। ধর্ষণ কেবল নারীর দোষে হয় না, মূলত পুরুষের দোষেই হয়। তাই পুরুষকে নিজের যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করতে না বলে একজন নারীকে বোরকা পরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো সম্ভাব্য অপরাধীর পরিবর্তে সম্ভাব্য ভিকটিমকে সাজা দেয়া। পুরুষের মধ্যে যৌনতার নিয়ন্ত্রণ নেই বলে নারীকে কেন ‘পর্দা’ তথা একটি ‘ভ্রাম্যমান জেলখানা’র ভেতরে জীবন কাটাতে হবে? ‘ছোট’ পোশাক বা ‘পর্দা’র কোনটা পরবে, এটি নারীর চয়েস; বাধ্যতামূলক প্রেসক্রিপশন হতে পারে না।

জেলখানার একটি কক্ষ যেমন একজন ব্যক্তিকে বন্দি করে, তাকে বাইরের জগত থেকে আলাদা করে এবং তার পছন্দ অনুযায়ী স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধা দেয়, একটি বোরকা বা ‘পর্দা’ ঠিক তেমনিই একজন নারীর স্বাধীন চলাফেরাকে বাধাগ্রস্ত করে, তার চয়েসকে অস্বীকার করে। কিন্তু এই দুইয়ের পার্থক্য হলো, জেলখানা একজন অপরাধীকে বন্দি করে আর একটি তথাকথিত ‘পর্দানশীন’ পোশাক অন্য কেউ অপরাধ করতে পারে – এই অজুহাতে একজন নিরপরাধকে বন্দি করে। একজন নারী কেবল ‘ছোট’ বা ‘খোলামেলা’ পোশাক কেন, কোনো পোশাক একেবারেই না পরলেও নিজের চোখ এবং পুংদ-কে সামলে রাখার মতো সংযম শিখতে হবে। নিজের ওপর এইটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা অসভ্যতার লক্ষণ, বিবর্তনের ধারায় পিছিয়ে থাকা পশুত্বের লক্ষণ; মেয়ে দেখলাম আর হামলে পড়লাম – এটি কোনোভাবেই বিবর্তনের ধারায় শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ নয়, আর এর মধ্যে গৌরব করার কিছু নেই!

সজীব সরকার

পুরুষকে নিজের যৌনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে; নারীকে ‘সামলে চলা’র উপদেশ দেয়ার আগে পুরুষকে নিজের ‘রাজদ-’ সামলে রাখতে শিখতে বলা দরকার। পুরুষকে বুঝতে হবে, নারীর শরীরে কেবল মাংসপিণ্ডই থাকে না, তার একটি হৃদয়ও থাকে; সেটির সন্ধান করা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সন্ধান পেলে তা বরং পুরুষের জন্যে মঙ্গলজনকও বটে।

পুরুষদের অবস্থা আসলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘লোকটা জানলই না’ কবিতার ‘লোকটার’ মতোই; ওই কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন :

“বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায়! হায়! লোকটার ইহকাল পরকাল গেল!
অথচ আর একটু নীচে হাত দিলেই
সে পেতো আলাদ্বীনের আশ্চর্য প্রদীপ,
তার হৃদয়!”

– পুরুষেরাও নারীর শরীরে কেবল মাংসই খুঁজে বেড়ায়; যেন মাংসেই জীবনের সব প্রাপ্তি, সব সুখ! অথচ মাংসপি-ের আড়ালে নারীর যে অমূল্য হৃদয়, তার সন্ধান করতে জানলো না!

সজীব সরকার: সহকারি অধ্যাপক; জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। লেখক ও গবেষক।
[email protected]

শেয়ার করুন: