লিপিকা তাপসী:
একটা অনলাইন পত্রিকা পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইনের খসড়া বিধিমালার উপর রিপোর্ট করে করেছে এই শিরোনামে ‘পুত্রবধূও বাধ্য সেবা দিতে’ এবং সেটি ৫৯ হাজারের মতো শেয়ার হয়েছে। কিছু প্রিন্ট মিডিয়ার কিছু পত্রিকাও এই ধরনের শিরোনাম করেছে। এই রিপোর্ট দুই ধরনের মানুষ শেয়ার করেছে; এক, যারা এটিতে বিরক্ত হয়েছে এই ভেবে যে এটি খুব পিতৃতান্ত্রিক একটা আইন হয়েছে, এটা কেমন কথা শুধু পুত্রবধু সেবা দেবে, আর কন্যার জামাতা’রা শুধু জামাই আদরই খেয়ে যাবে, কোন দায়িত্ব নেবে না।
আর আরেক দল এটা দেখাতে এই যে দেখো পুত্রবধুরা সাবধান, তোমরা শ্বশুর শাশুড়ির সেবা দিতে বাধ্য, তার জন্যে আইন হয়েছে। এটা তোমাদেরই দায়িত্ব। এটা পুত্রবধুদেরকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে।
আমরা চিলের পিছে কান নিয়েছে গল্পের মত কেউ বললেই তার পিছে দৌড়াতে থাকি চিলে কান নিয়েছে বলে। যাচাই করে দেখি না আসলে আইনে কী আছে? এখন দেখি আইনে কী আছে?
২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি আইন প্রণয়ন করা হয় যেটি ‘পিতা-মাতা ভরণ পোষণ আইন ২০১৩’ নামে অভিহিত করা হয়। এই আইনে ‘সন্তান’ বলতে পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান ‘পুত্র বা কন্যা’ কে বোঝানো হয়েছে। এখানে দায়িত্ব নেবার ক্ষেত্রে উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শুধুমাত্র পুত্রই বাবা-মার দায়িত্ব নেবে কিংবা মেয়েরা নেবে না সেরকম কথা বলা হয়নি। এখানে পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা, নানীর ভরণপোষনের কথাও বলা হয়েছে। আইনে পিতামাতার ভরণপোষণে ব্যর্থ হলে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থ দন্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানেও সন্তানের স্বামী বা স্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে পুত্রবধু বাধা প্রদান করলে যে দণ্ড পাবেন, একই সাথে এই কাজের জন্যে জামাতাও একই দণ্ড পাবে।
কিন্তু বিধিমালার ১৮.১ এ বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতাকে যথোপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করিতে হইবে’
১৮.২ এ বলা হয়েছে ‘সন্তান নিজে উপস্থিত থাকতে না পারিলে তাহার স্ত্রী, সন্তান বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ দ্বারা পিতা-মাতার যথোপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করিতে হইবে।’
এখানে এসে সন্তানের ‘স্বামী’ বাদ পড়েছে। এটি আইনের সাথেও বিরোধপূর্ণ। কারণ আইনে ‘সন্তান’ বলতে পরিস্কারভাবে পুত্র-কন্যা উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। বিধিমালাতে ১৮.২ এ স্ত্রী’র পরে স্বামী শব্দটি যোগ করতে হবে। কিন্তু এটাকে পিতৃতান্ত্রিক মিডিয়ার কিছু প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা রসিয়ে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে শিরোনাম করেছে ‘পুত্রবধুও সেবা দিতে বাধ্য’।
অনলাইন পত্রিকাটিতে রিপোর্ট হয়েছে এভাবে “বিয়ের পরই ছেলেদের ‘পাল্টে’ যাওয়ার অভিযোগ বেশিরভাগ মা-বাবার। এজন্য দায়ী করা হয় ছেলের বউদের। দেখা গেছে, স্বার্থের টানাপড়েনে নাড়িছেঁড়া সন্তান অসহায় মা-বাবাকে বের করে দিচ্ছে বাড়ি থেকে, রাখছে গরু-ছাগলের সঙ্গে গোয়ালঘরে।
আর চাকরি বা অন্য কোনো কারণে ছেলে দূরে থাকে- এমন মা-বাবাদের দুর্দশার যেন অন্ত নেই। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাবার না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক স্ত্রীর বিরুদ্ধে। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা না করার এই মনোভাব পাল্টাতে হবে স্বামী দূরে থাকা স্ত্রীদের। ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ’ বিধিমালার খসড়ায় স্পষ্ট করে মা-বাবার উপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে “
ও হে মগজে আবর্জনা ভর্তি মিডিয়া, বিয়ের পরে ছেলে পাল্টালে সেই দায় ছেলের, সেই দায় বউদের নয়। প্রথমত বিধিমালার ব্যাখা করতে গিয়ে এধরনের নিজের মনস্তাত্বিক ব্যাখা এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন অন্যদিকে এর মাধ্যমে সমাজে দুগর্ন্ধ ছড়িয়ে সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাবা-মা কার? ছেলের না বউয়ের? বাবা-মা খেয়ে না খেয়ে, ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে মানুষ করেছে কাকে, ছেলেকে না বউকে? উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে না চাপিয়ে যার দোষ তাকে দিতে শেখেন। বাবা-মা তার সন্তানকে বড় করে, ছেলের তার বাবা মায়ের মায়া মমতা থাকার কথা । একজন বাইরের মানুষ এসেই তা সহজেই পাল্টে ফেলছে তাহলে ছেলের মায়া মমতাকতটুকু আছে সেই প্রশ্ন করতে শিখেন। সেই ছেলে কতটা অমানুষ সেইটা লেখেন। ছেলেকে সাধু বানানো বন্ধ করেন। সন্তানকেই প্রথমত বাবা-মায়ের পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে হবে, মানবিক হতে হবে । তারপর তাদের বউরা, স্বামীরা সেইভাবে সহযোগী হবে। আর কন্যা সন্তানের পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব নিশ্চিত করতে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে সমান অংশীদারও করতে হবে।
আইনের কিছু ধারা নিচে দেওয়া হলো:
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ তে বলা আছে:
২/ঘ. সন্তান’ অর্থ পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান ‘পুত্র বা কন্যা’
৩/ ১) প্রত্যেক সন্তানকে তাহার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিতে হইবে।
(২) কোন পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকিলে সেই সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করিয়া তাহাদের পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিবে।
(৩) এই ধারার অধীন পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিবার প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করিতে হইবে।
(৪) কোন সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার, বা ক্ষেত্রমত, তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ করিবে না।
(৫) প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করিবে।
(৬) পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হইতে পৃথকভাবে বসবাস করিলে, প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তাহার, বা ক্ষেত্রমত, তাহাদের সহিত সাাক্ষাত করিতে হইবে।
(৭) কোন পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সহিত বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেইক্ষেত্রে পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয় বা বাৎসরিক আয় রোজগার হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমান অর্থ, বা ক্ষেত্রমত, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমত, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করিবে।
দণ্ড: ৫। (১) কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যে কোন উপ-ধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্দ্ধ ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবে; বা উক্ত অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনুর্দ্ধ ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।
২) কোন সন্তানের স্ত্রী, বা ক্ষেত্রমত স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তি ভরণ পোষণে বাধা প্রদান করিলে বা অসহযোগিতা করলে একউ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
(পাঠকদের সুবিধার কথা ভেবে নিচে দুটি লিংক দেয়া হলো)