রেজাউল করিম:
আমার যখন দু’বছরের মতো বয়স আমার মা আমাদের সাত ভাইবোনকে নিয়ে জন্মভিটা (খুলনা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম) ছেড়ে সাতক্ষীরা চলে আসেন। সাতক্ষীরা জেলার ইটাগাছা গ্রামে একজনের পরিত্যক্ত জমিতে ঘর তুলে বসবাস শুরু করি। এটা ছিলো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা।
সেখানে প্রায় ৬০/৭০ টি হিন্দু পরিবার ছিলো! আমি বেড়ে উঠেছি হিন্দুদের সঙ্গে। আমার বন্ধুদের প্রায় সবাই ছিলো হিন্দু। একসময় আমরা পিতৃহীন হয়ে (পিতা জীবিত থেকেও আমাদের কাছে মৃত) চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছি। এমনও সময় গিয়েছে যে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল তবুও বাড়িতে রান্না হয়নি কিছু। আশি নব্বইয়ের দশকে মানুষের কষ্ট গেছে অনেক। কার্তিক মাস এলে মানুষের ঘরে নীরব দুর্ভিক্ষ লেগে যেত। তবে আমার তাতে কি যায় আসে! সোজা চলে যেতাম সুকুমার কাকীর কাছে (কাকীর ছেলের নাম সুকুমার)। আমার মনে আছে কাকী আমাকে কোলে বসিয়ে তাঁর থালা থেকে আমাকে ভাত খাওয়াতেন। কাকী বাড়িতে না থাকলে চলে যেতাম অনিমা দিদির বাড়িতে। এক থালা ভাত, দুধ আর সঙ্গে দিতেন খাঁটি খেঁজুরের গুঁড়। তৃপ্তি ভরে খেয়ে নিতাম। তারপর দিদির বাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়তাম। হয়তো ঘুমের মধ্যেই কোন এক ফাঁকে মা এসে তুলে নিয়ে যেতেন। ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতাম আমি আমাদের বাড়িতে শুয়ে আছি।
বাড়ির পাশে ছিলো সড়ক ও জনপদ বিভাগের কলোনি। সেখানে প্রচুর ফলজ গাছ ছিলো। আমার হিন্দু বন্ধুদের নিয়ে জ্যৈষ্ঠের আগুন ঝরা দুপুরে যেতাম আম কুড়াতে। দুপুরের হালকা বাতাসে পাকা আম ঝরে পড়তো। সে আমের স্বাদ অন্যরকম। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো, গাছের ফল চুরি আবার কখনো কখনো মারামারিও হতো। সেসব বন্ধুদের নাম আজও আমি ভুলিনি। শ্যামল, সুবর্ণ, মনীন্দ্র, খগা, প্রতাপ, বীরেন।
তবে সবচেয়ে মজা হতো পূজোর সময়। ঢাকের তালে তালে নাচা হই হুল্লোড় আর সুস্বাদু প্রসাদ আহ! সেসব কি ভুলা যায়! আমাদের বাড়িতে থালা ভরে আসতো প্রসাদ। লুচি, ডাল, কলা, বরই, মিঠা আলু, আপেল আরও কতকিছু!
নরেন কাকা নতুন বিয়ে করেছে। নতুন কাকীর নাম বিন্দি। খুব সুন্দরী ছিলেন। আমি বিন্দি কাকীকে কাকী বলতাম না, ডাকতাম বৌদি। তাতে নরেন কাকা রাগ করতেন না। বিন্দি বৌদি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। একবার নরেন কাকা গেছে তার পিঁসির বাড়িতে পিঁসিকে আনতে। ভালো রান্নাবান্না করতে হবে। নরেন কাকার পিঁসি মোরগের ঝোল খেতে নাকি খুব পছন্দ করেন। কিন্তু নরেন কাকা মোরগ না কেটে চলে গেছেন পিঁসিকে আনতে। বিন্দি বৌদি আমাকে দিলেন মোরগ কাটতে। বৌদি আবার কাটাকুটি দেখতে পারেন না। আমরা মুসলমানরা তো ধড় থেকে মাথা আলাদা করি না। কিন্তু হিন্দু রীতিতে আলাদা করার নিয়ম।
আমি শুধু বললাম, বৌদি তুমি চোখ বন্ধ করে পা আর ডানাগুলো ধরে রাখো বাকিটা আমি দেখছি। এদিকে আমি মুসলিম রীতেতে মোরগ জবেহ করে বৌদিকে বললাম ঝুড়ির মধ্যে ফেলতে। বৌদি ফেলে দিলো। আমি মোরগ জবেহ করে বাড়ি চলে আসলাম। এর কিছুক্ষণ পর আবার ডাক পড়লো। বৌদি বললো একি করেছিস! তুই মোরগের ধড় ফেলিস নি। এখন কি হবে? আমি সরল সোজা বললাম, ধড় ফেলতে হয় নাকি? শিগগির ধড় ফেল। আমি মরা মোরগের ধড়, মাথা আলাদা করে দিলাম। বৌদি বললেন, খবরদার মোরগ কাটার কথা কাউকে বলিস না যেন! রাতেই পিঁসি এলেন। আমারও ডাক পড়লো! পেট পুরে মোরগের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বাড়ি ফিরলাম।
আমার প্রথম কষ্ট এই বিন্দি বৌদিকে নিয়ে। একদিন সন্ধ্যাবেলা বৌদি আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। মনে মনে ভাবি হয়তো নরেন কাকা বৌদিকে বকাঝকা দিয়েছে কারণ কাকা বৌদিকে কখনো মারতেন না।
পরদিন সকালে শুনি কাকা আর বিন্দি বৌদি ইন্ডিয়া চলে গেছে। তারা আর কখনো ফিরবে না। কেন চলে গেলো? মাকে বললাম, মা বিন্দি বৌদি চলে গেলো কেন? মা আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। পরে অনেক বড় হলে জেনেছি কমিশনারের ছেলের চোখ পড়েছিলো বিন্দি বৌদির উপর। এর কিছুদিন পর আমরাও সাতক্ষীরা ছেড়ে ফিরে আসি আমাদের জন্মভিটায়।
গত দু’বছর পূর্বে সেই ইটাগাছার হিন্দু পাড়ায় গিয়েছিলাম। এখন সেখানে মাত্র তিন ঘর হিন্দু পরিবার আছে। সুকুমার কাকী আছে। কাকীকে বললাম- সুকুমার দাদা কৈ? বললো- ও ইন্ডিয়ায় থাকে। তা আপনি যাননি কেন? আমি যাবো না। স্বামীর ভিটা রেখে কৈ যাবো আমি!
এই ফাঁকে একটা তথ্য দিয়ে রাখি। ১৯৩০ সালে বাংলাদেশে হিন্দু এবং মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো প্রায় সমানুপাতিক। ১৯৭২ সালে হলো ১৮%, ২০০১ সালে এসে সেই সংখ্যা হলো মাত্র ৮.৫% আর বর্তমানে মাত্র ৭% কেন এই অসঙ্গতি?
খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ছবি। হামলা, মামলা দিয়ে উচ্ছেদ করা হয় তাদের। হত্যা, ধর্ষণ থেকে শুরু করে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। কৈ যাবে হিন্দুরা? হাজার বছর ধরে এরা বসবাস করছে এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে।
আমাদের পূর্ব পুরুষ সরাসরি শেখ, সৈয়দ বংশের নয়। আমাদের শরীরে কোন না কোনভাবে বইছে হিন্দু রক্ত। আর সেই হিন্দু রক্তের সঙ্গেই আজ আমরা বেঈমানী করি। এর খেসারত একদিন গুনতে হবে আমাদের। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার, ইয়েমেনের আকাশের মতো একদিন এই বাংলাদেশেও ধর্মীয় বোমা ফাঁটবে। বিগত কয়েক বছরে তার উপস্থিতি কি টের পাচ্ছেন?
তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে খুঁজে ফিরি আমার সেই হিন্দু বন্ধুদের। খুঁজে ফিরি অনিমা দিদি, বিন্দি বৌদিকে, নরেন কাকাকে। কেমন আছে ওরা? খুব কি ভালো আছে!? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে!