লতিফা আকতার:
নারীর জীবনের অনেক কঠিন বাস্তবতার দুইটি দিক।
ধর্মের আলোকে এবং নিজস্ব মতামতের এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি- উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা। আর এই সমাজ ব্যবস্থায় বৈবাহিক জীবনে নারী অনেক অলিখিত শর্ত নিয়ে সংসার জীবনে পা রাখে।
একেক ধর্মে নারীর একেক অবস্থান। কিন্তু সংসার ধর্মে সকল নারীর অবস্থান একই। প্রাগৈতিহাসিক যুগের নির্ধারিত নারীর ভূমিকা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পরিবর্তন হয়নি। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তাঁর নির্ধারিত দায়িত্বসহ আরও পাঁচটা দায়িত্ব ঘাড়ে চেপেছে।
শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা এই প্রস্তাবিত আইনের আগেও নারী করেছে, করছে। কেননা নারীর ভরণপোষণ তাঁর স্বামী বহন করে। আর একজন সক্ষম নারীকে প্রায়শই শুনতে হয়- তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন চায় বলে সে চাকুরি করতে পারে। উপার্জিত বেশিরভাগ অর্থ সংসারের পিছনেই খরচ করা হয়ে থাকে। তার উপর সংসারের বাড়তি চাপ নেওয়া লাগে। এক চাকুরি করতে পারার স্বাধীনতা বজায় রাখতে বাড়ির কাজে আরও বেশি বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। সংসারের পাঁচটা মানুষের নানান অভিযোগ শুনে শুনে পথ চলতে হয়। একজন কর্মজীবী নারীর অনুকূল শ্বশুরবাড়ি এ সমাজে কদাচিত।
এর বিপরীত একটা দৃশ্যও রয়েছে। বাড়ির জামাই। আর “জামাই আদর” বলে একটা কথাও প্রচলিত আছে। কন্যার সুখের জন্য জামাই’র যত্নে শাশুড়ি নিয়োজিত থাকে। সাথে বাড়ির বউকেও কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। সুবিধা কিন্তু সব পুরুষের দিকেই যায়।
বউ আদর বলে কোন শব্দ আদৌ প্রচলিত থাকলেও, ছেলের অন্ন ধ্বংস করা বউয়ের ক্ষেত্রে তাঁর প্র্যাকটিস নাই। আর এইসব আপেক্ষিক বিষয়ে আইন হতে হলে সবার কথা মাথায় রেখেই চূড়ান্ত হওয়া উচিত। পুত্রবধু উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যাবে তা কেন? শারীরিকভাবে সক্ষম শাশুড়িকেও সংসারের কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। জামাই শুধু আদর নিবে না। তাকেও কিছু নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। পুত্রবধুকে আইনের মাধ্যমে সেবা প্রদানে বাধ্য করা হলে- তাঁর ভালোবাসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসমতা দূরীকরণে আইন থাকা বাঞ্ছনীয়। এমনিতেই বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোতে বউয়ের ভূমিকা ভাসমান। প্রচলিত “পরের বাড়ি” শব্দটা তাঁর প্রমাণ বহন করে। পাছে এই আইন তাঁকে আরো ভাসমান না করে তোলে!!
নারীর ভাসমান জীবনে, পৈতৃক সম্পত্তি আর এক জটিলতা। বেশ কিছু ধর্ম নারীর সম্পত্তি প্রাপ্তি’র সুযোগ রাখেনি। কিন্তু মুসলিম নারীরা পিতার সম্পত্তিতে অধিকার রাখে। বণ্টনের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু সে অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ নারীই খুব একটা আগায় না। সামাজিক কিছু ফালতু সংস্কার আর ভালোবাসা হারানোর ভয় কাজ করে। কেউ কেউ তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করলে- তাঁকে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তার জন্য বরাদ্দ থাকে সম্পত্তির সবচাইতে খারাপ অংশ। আর সে অংশ মেপে বুঝে পেতে বহু কাঠখড় পোড়ানোর পাশাপাশি নিজের মানসিক স্বস্তিও পুড়তে থাকে। চিরচেনা সম্পর্ক তখন অন্যরূপে আবির্ভূত হয়।
আসলে নারী জীবনের বস্তুগত ও অবস্তুগত সবকিছু পেতে সব সময়ই প্রচুর কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। হোক না সেটা যত্ন কিংবা সম্পত্তি। প্রাপ্তি এবং প্রদানের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণতা রেখে আশা করি এই দুই আইন সুফল আনবে। সেবা প্রদানে শুধু পুত্রবধুই নয়, জামাতাও সমান দায়িত্ব পাবে।
মনুষ্য সম্পর্কে যতো শৈথিল্য, অসামঞ্জস্য এসেছে তত আইনের উদ্ভব হয়েছে। আর সবচাইতে দুঃখজনক আইনের সঠিক বাস্তবায়নের অভাব। একটা বিষয় বুঝি- যদি আইনের মাধ্যমে কিছু পেতে হয়, সেখানে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। আর তার অপেক্ষায় আমরা।