ফারহানা আফরোজ জাহান:
“Every women are working women, few are salaried” – এই কথাটি বেশ জনপ্রিয় একটি উক্তি হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় … কথাটি সত্য, খুব বেশি সত্য।
আমার বৌ কিছু করে না বলে যারা বৌদের পরিচয় করিয়ে দেন, তারা নিজেরাও খুব ভালো করেই জানেন ঘরের ছোট-বড় সব কাজই কে করছে বা কার তত্ত্বাবধানে হচ্ছে! তাহলে সমস্যাটা কাজ করা বা না করা নিয়ে নয়। সমস্যাটা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির, সমস্যাটা হচ্ছে মানসিকতার, সমস্যাটা হচ্ছে স্বীকৃতির।
আমাদের সমাজে কাজের লিঙ্গ আছে; স্পষ্ট বিভাজন আছে কোন কাজগুলো নারীর এবং সেই কাজগুলো নারীরাই করে। আমাদের ছেলেদের ছোটবেলা থেকে সেই শিক্ষাই দেয়া হয়। পারিবারিকভাবেও আমরা কাজের লিঙ্গ নিয়েই বেড়ে উঠি। তাই নারী যে কাজ করে সেগুলোকে আর আলাদাভাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না কেউ, এমনকি স্বয়ং নারীরাও না।

আপনি বাইরে চাকরি না করা একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন তো, “আপনি কী করেন?” একশো ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হলো, “আমি? আমি তো কিছু করি না!” এখন তাহলে প্রশ্ন হলো, কাজের নারী করা? যারা চাকরি করে ও বেতন পায়, তারাই। সহজ উত্তর। তারা কাজ করে না, এটা বলে এমন সাধ্য কার? সমাজ জানে, রাষ্ট্র জানে সে কাজ করে, তার কাজ স্বীকৃত!
সমাজের চোখে যারা কাজের নারী, তারা আসলে বাড়তি কাজের দায়িত্ব কাঁধে নেয় এবং তা পালন করে। কাজের নারীদের নারীর সকল কাজই করতে হয় সাথে অতিরিক্ত হিসেবে চাকরি। একজন নারী অফিস থেকে ফিরে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে সংসারের কাজ নিয়ে, যেমন রান্না করা, বাচ্চার দেখাশোনা (যদি থাকে), বাচ্চাকে পড়ানো, অন্যদিকে পুরুষ সদস্যটি হাত মুখ ধুয়ে বসে পরে টিভির সামনে। তার সময় কাটে টিভির এই চ্যানেল থেকে সেই চ্যানেলে ঘোরাফেরা করে। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে আমার কথা বলার জায়গা সাধারণ নিয়ে, ব্যতিক্রম নিয়ে নয়।
কাজের নারীদের পারিবারিক জীবন আর চাকরি জীবনের মধ্যে প্রতিনিয়ত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়। এখানে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ আনাটা নেহায়েত বাহুল্য। বেশির ভাগ চাকরিজীবী নারীদের অফিসের সময় কাটে কাজ করে, আর ফাঁকে ফাঁকে চলে পরিবার সামলানো। বেশির ভাগ চাকরিজীবী নারীদের বিকেলের দিকের ফোনালাপ যদি ট্র্যাক করা যায় দেখা যাবে, তারা কথা বলছে বাড়িতে থাকা কারোর সাথে, রাতে কী রান্না হবে সেই বিষয় এ। বিকালে টেবিলে কী নাস্তা থাকবে, পরিবারের কোন সদস্য কী খাবে তার নির্দেশনা চলে।
আর সর্বশেষ বাণী, “দেখি আমি যত তাড়াতড়ি পারি আসছি”। তারপর তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরে বাকি সময়টুকুর দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। কোনো পুরুষের এই ধরনের কোনো কাজ করতে হয় বলে মনে হয় না। তাই তাদের অফিস পরবর্তী সময়টুকু তোলা থাকে একান্ত তাদের মতো করে সময় কাটানোর জন্য; সেটা ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে; টিভি দেখে, খেলাধুলা করে, কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। ঘরে ফেরার তাড়া তাদের নেই। তাদের তো ঘরে গিয়ে রান্না করতে হবে না, বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে না, বাচ্চাকে পড়াতে হবে না! এগুলো তো স্ত্রীলিঙ্গীয় কাজ! পুরুষ করলে তার জাত যাবে না! বন্ধুরা টিটকারি মেরে বলবে, বৌয়ের কাজ করে! কী দরকার?
তুমি নারী, কাজের নারীই হও, আর ঘরেই থাকো, নারীর কাজ তুমিই করো, ভারসাম্য রক্ষা করে চলো, আর না পারলে কাজ ছাড়ো! একবারও কি আমরা চিন্তা করি সে একলা কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবে? তার কি কোনো সমর্থন প্রয়োজন নেই? বাড়িতে মেহমান এসেছে, তাদের খাবার কী হবে বা কীভাবে হবে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নারী তোমার! বাচ্চা অসুস্থ; সারা রাত জেগে পরদিন কীভাবে অফিস করবে, সেটাও তোমার ভাবনা। যারা ভাগ্যবতী, তারা খুব ভালো সাহায্যকারী পেয়ে যায়, ঘরের কাজ করার কিংবা বাচ্চা সামলানোর। কেউ কেউ মা-বাবা বা শ্বশুর-শাশুড়ির সাহায্য পেয়ে থাকেন। যাদের এসব সমর্থন নেই, তারা কী করবে?
সহজ উত্তর তারা কাজ করবে না মানে চাকরি করবে না। ঘরের সব কাজ করবে আর দিনশেষে শুতে যাবে, “ওতো কিছু করে না কিংবা সারাদিন কী যে করো, বুঝি না” এই টাইপের মহান বাণী শুনে।
কাজের নারীরা সবাই কমবেশি ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন বা চলার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টায় যদি বাড়ির পুরুষ সদস্যটির সমর্থন থাকে, তাহলে অন্তত মানসিক সাহায্যটা পাওয়া যায়! কাজের নারীদের নিজেদের জীবন বলে কিছু থাকে না বা একান্ত কোনো সময় তাদের নেই। এমন অবস্থায় সহমর্মিতার হাতটা যদি কাছের কারো কাছ থেকে পাওয়া যায় সেটা অনেক বড় নির্ভরতার জায়গা তৈরি করতে পারে তার জন্য! পুরুষরা স্ত্রী লিঙ্গীয় কাজ করবেন না ভালো কথা, কিন্তু ভালোবাসা, সহযোগিতা কিংবা সহমর্মিতা; একজন মানুষ হিসেবে আপনার মধ্যে থাকতেই পারে। কেন তাদের নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখবেন! এগিয়ে দিন না আপনার ভালোবাসা, সহযোগিতা কিংবা সহমর্মিতার হাতটি। দেখবেন খুব খারাপ সময় আপনার কাটবে না!
গবেষণা কর্মী