যেকোনো সম্পর্কেই ‘কমিটমেন্ট’ অত্যন্ত জরুরি

ইলা ফাহমি:

বিয়ে, দুজন মানুষের সাইন ছাড়া কিছু নয়? কখনো তা দুজন মানুষেরই সাইনসাবুদসহ তথাকথিত লিগ্যাল সম্পর্ক, কখনো তার সাথে জড়িত পরিবার ও সমাজ।
একজন মানুষ আত্মহত্যা কখন করে? স্পষ্টতই এটা মানসিক অসুস্থতা। মানসিক অসুস্থতাকে বাঙালী ‘পাগল’ বলে ভাবলেও মানসিক অসুস্থতার ধরন, প্রকাশ ভিন্ন। সিভিয়ার ডিপ্রেশন একটি মানসিক অসুস্থতা, যেভাবে বাইপোলার ডিজঅর্ডার কিংবা পিএমডিডি, একে পাগলের খাতায় নাম লেখাতে পারবেন?

দিনকয়েক আগে প্রিমিন্সট্রুয়েশনাল ডিপ্রেশন নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, এক জনপ্রিয় ব্লগার গালিগালাজ করে ইনবক্সে বলেছিলেন, এইসব তথাকথিত পশ্চিমা রোগ/অসুস্থতাকে জাস্টিফাই করার কিছু নেই, নারীবাদীরা নাকি ইদানিং তাই করে যাচ্ছে। বিষয়টা পশ্চিম বা পূর্ব, উত্তর বা দক্ষিণের নয়। বিষয়টা মানুষের, বিষয়টা মানবিক। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো মানুষের মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে, পশ্চিম সেটা মেডিকেল সায়েন্সে আইডেন্টিফাই করতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা সচেতন। এজন্য একে পশ্চিমা বলার কোন কারণ নেই!

আমি নিজে সুইসাইড সারভাইভার। একবার সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম, কারণটা উহ্যই থাক, আর উহ্য থেকে তা বিভিন্নজনের গসিপিংয়ের খোরাক হোক, তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলাম না বলে মাত্রা কম হয়ে গিয়েছিলো, বেঁচে গিয়েছিলাম। এরপর যতবারই ভেবেছি, একটি কথাই মনে হয়েছে-‘আমি মানসিকভাবে সুস্থ ছিলাম না’। পরবর্তীতে সেটা আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি কিছু মানুষের সাহচর্যে এবং আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।

এটুকু বলতে পারি-‘আমি ভবিষ্যতে কখনো আত্মহত্যার মতো কাজ করবো না যতদিন সুস্থ আছি এবং আমি নিজেকে সুস্থ রাখতেও চাই’। সেই সুস্থতার জন্য যা করা দরকার তা এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেনে নেবে কিনা সেটা ভাবলে মাঝেমধ্যে হাঁসফাঁস করি, আসলেই তো সমাজ নারী হিসেবে আমার সুস্থ থাকার কর্মকাণ্ডকে মেনে নেবে না।

নারী মানে অর্ধাঙ্গী, নারী মানে মা, নারী মানে নির্ভরশীল, নারী মানেই বেশ্যা, নষ্টা কলঙ্কিনী। নারী মানে আসলে কোনভাবেই একা কোন সত্তা নয়, কারো না কারো সাথে সে জড়িত! একা নারীকে এ সমাজ মেনে নেয় না, কারণ তা খোদ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের টিকে থাকার জন্যই ভয়ংকর।

ধরুন আজ আমি চাইছি বর্তমান সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবো, কেননা এখানে জীবনকে যাপনের রসদ ফুরিয়ে গেছে। জীবন যেহেতু আমি যাপন করছি, সেহেতু আমিই একমাত্র জানি কী কতটুকু কোন মাত্রায় বহন করছি, সহ্য করছি। সমাজ বলবে-‘ডিভোর্সী!’ এ শব্দটুকুতে আটকে থাকবে না বৈকি; সকালের রোদে, দুপুরের অফিসের ডেস্কে, বিকেলের পাবলিক প্লেসে, রাতের ডাইনিং টেবিলে আলোচনার খোরাক হবে।

সমাজ এখনও নারীকে একা চিন্তা করতে পারে না। অন্যদিকে আমার সাথে যে সঙ্গীটি আছেন, মানে আমরা দুজনও এই সামাজিক চাপ, তথাকথিত সুখী পারিবারিক তকমা, পরিবারের অন্যান্য মানুষদের দুঃখীমুখ না দেখতে চাওয়া, দুজন একসাথে থেকে নিজেদের ভবিষ্যত বেঁচে থাকার পথ মসৃণ রাখবার চেষ্টা, সন্তানের ভবিষ্যত, তথাকথিত বিবাহিত জীবনের সুখী দাম্পত্যসুলভ চাহনি এবং সমাজের গ্রহণযোগ্যতা এবং দুজনের মায়া/ভালোবাসা/ভালোলাগার বোধ সবকিছু মিলিয়েই সম্পর্ক ছেদ করাটা দুরূহ হয়ে পড়ে।
এরপর? সামাজিক চাপে একটা টক্সিক রিলেশনকে টেনে নিতে নিতে মানসিক অসুস্থতাগুলো ডালপালা মেলে, মেলতে মেলতে সেই ডালেই ঝুলে পড়ে কেউ কেউ। যে এখনো মরেনি, সেও যে এই সম্পর্কের ভেতরে থেকে দিনে কয়েকবার করে মরছে না, তা কে জানে?

বহুগামিতা অন্যান্য সেক্সুয়াল আইডেন্টিটির মতো একটি আইডেন্টিটি। তবে সম্পর্কের কমিটমেন্টে যাবার আগেই নিজের সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি অপরপক্ষের কাছে পরিষ্কার করা উচিত, কেননা যার সাথে জড়াচ্ছেন তিনি আপনার আইডেন্টিটিকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন কিনা, তা বোঝা জরুরি, খুব জরুরি। লুকিয়ে ছুপিয়ে সম্পর্কের ভেতরে আরেকটি সম্পর্ক করা অপরাধ, যে অপরাধ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শাস্তির অপরাধ না, সে অপরাধ নৈতিকতার অপরাধ। নৈতিকতা কার কেমন সে মানদণ্ড শুধুমাত্র সেই দুজন মানুষই নির্ধারণ করতে পারে। আর সঙ্গীকে না জানিয়ে কোনকিছুতে জড়িত হওয়া প্রতারণাই বটে!

তবে এজন্য আত্মহত্যাকে জাস্টিফাই করা যায় কী যায় না, সেটা আত্মহত্যা করা মানুষটির মগজের ধারণক্ষমতা, কষ্টের বোধ, এসব থেকে মানসিক অসুস্থতা দিয়ে যাচাই করা উচিত। সেই জাস্টিফিকেশন এক কাপ চা, একটি জ্বলন্ত সিগারেট, ভাবগম্ভীর আলোচনা, মদের গেলাস হাতে রগ ফুলিয়ে বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসার মতো ব্যাপার না। পর্দার আড়ালের গল্প আমরা কজন জানি বা জানতে চাই?

যার নেবার ক্ষমতা আছে, তিনি বহুগামিতাকে নিতে পারবেন, এমন বহু উন্নত মগজের মানুষ আছেন আশপাশে। যারা নিতে পারবেন না তারা কি অপরাধী? আত্মহত্যা অপরাধ আইনে, আত্মহত্যা অসুস্থতাও বটে মেডিকেল সায়েন্সে।

আর বহুগামিতা? ‘মানুষ মাত্রই বহুগামী’ এ তিন শব্দের বিশ্লেষণে আপনারা যেতে পারেন, আমি পারি না। আমার আরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে! ‘বহুগামিতা আদিম, তাই তা মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ -মানুষ তো কাপড় কিংবা আগুনের আবিষ্কারের চেয়েও আদিম প্রাণী। তাই বলে কি উলঙ্গ থাকা কিংবা কাঁচা খাবার খাওয়াও বর্তমানে স্বাভাবিক? কোনটাকে জেনারালাইজ করে ‘স্বাভাবিক’ বলছেন?

২০১৮ সাল অবধি আসতে মানুষ যতটা পরিশ্রম করেছে সভ্যতার উন্নয়নে, বহু আদিম বৈশিষ্ট্য আর ‘জেনারালাইজড স্বাভাবিক’ না, বরং বলা যায়, জেনেটিক কোডে কারো কারো রয়ে গেছে আদিম প্রবৃত্তি, সবার জন্য তা স্বাভাবিক নয়। মানুষ যতটা প্রাকৃতিক কিংবা আদিম, তার চেয়েও মানুষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক! সভ্যতা এসেছে এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্যই, ২০১৯ সালে বসে আপনি ফেসবুক গুতোচ্ছেন প্রকৃতিকে জয় করেছেন বলেই, নতুবা আপনার জায়গায় শিম্পাঞ্জি, শেয়াল কিংবা তিমিও থাকতে পারতো। অস্বীকার করবেন না প্লিজ। মানুষ নিজের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির গলায় শেকল পরিয়ে বর্তমানে এসেছে, তাই সে প্রবৃত্তি সবার মাঝেই আছে কিংবা থাকতে হবে এটা বলাটা অনর্থক গোয়ার্তুমি। বর্তমানকে বর্তমান দিয়ে যাচাই করুন অতীতের নিরিখে, সম্পূর্ণ অতীতকে ঘাড়ে চাপিয়ে নয়।

এনিওয়ে, বহুগামিতা আমার কাছে একটি স্বাভাবিক সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি। এবং মনে করি যাদের ভেতর এ আইডেন্টিটি প্রকট আকারে আছে, তারা হয় মনোগ্যামি সম্পর্কে না জড়ানো উচিত, নতুবা সঙ্গীর সাথে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত। ‘সঙ্গীর নেবার ক্ষমতা না থাকলে বেরিয়ে আসুন’- কথাটা বলা সাড়ে চার সেকেন্ডে খুবই সহজ, কিন্তু বেরিয়ে আসাটা ততো সহজ নয়। যদিও সহজ হওয়াটা মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি, খুব জরুরি।

আর আত্মহত্যা? আমি চাই না পৃথিবীর আর একটি মানুষও আত্মহত্যা করুক।

বিঃদ্রঃ লেখাটি ছন্নছাড়া, নিজ গুণে/দোষে ক্ষমা করে দেবেন।

শেয়ার করুন: