সেজান মাহমুদ:
সুইসাইড বিষয়ে আমি লিখে আসছি বেশ কয়েক বছর হলো। কিন্তু সুইসাইড নিয়ে আমার গবেষণা সেই ১৯৯৮ সাল থেকে আমেরিকায় ছাত্র থাকাকালেই। বর্তমানে আমার এমডি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি টিম বা দলগত গবেষণা করছি, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে বই আকারে প্রকাশ করা যায়। এগুলো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
কিন্তু সম্প্রতি ডাক্তার আকাশের আত্মহত্যা নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ায়, আর তা নানান মাধ্যমে ছাপা হওয়ায় দুই রকমের প্রতিক্রিয়া পেলাম। মেজরিটি একটি ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার জন্যে সাধুবাদ জানিয়েছেন। একদল (মূলতঃ ডাক্তার আকাশের পরিচিত, বন্ধুবান্ধব বা চট্টগ্রামের বাসিন্দা এরা) গালিগালাল করছেন এই ভেবে যে আমি হয়তো মানসিক রোগী বলে আকাশকে ছোট বা হেয় করার চেষ্টা করছি।
এটাই প্রমাণ করে আমার স্ট্যাটাসটি কতোটা সত্য ছিল। আমি বলতে চেয়েছি, সুইসাইড একটি রোগ, যার পেছনে শতকরা ৯০% ক্ষেত্রেই আরও গভীর মানসিক রোগ থাকে। ১০-১৫% ক্ষেত্রে জিনেটিক বা বংশগত কারণ, পরিবেশগত কারণ।
লক্ষ্য করুন, এই যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, তা কিন্তু “মানসিক রোগ” নিয়ে সমাজে যে স্টিগমা, তার জন্যে হচ্ছে। আমি যদি বলতাম, ডক্টর আকাশের ডায়াবেটিস ছিল, তাহলে এতো গালিগালাজ শুনতে হতো না। এটাই মূল সমস্যা। মানসিক রোগ একটি অন্য যেকোনো রোগের মতোই। মানসিক রোগের জন্যে চিকিৎসা এবং পারিবারিক বা সামাজিক সাপোর্ট দুটোই জরুরি।

আমি এখানে মরহুম আকাশ এবং মিতুর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবো না, বরং এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আরও প্রয়োজনবোধ করলাম যে সুইসাইড নিয়ে ধারাবাহিক শিক্ষামূলক লেখা লিখবো বাংলাদেশের পাঠকদের জন্যে। কেউ প্রশ্ন করলে ভদ্রভাবে করবেন।
বলাই বাহুল্য, এখানে যা লিখবো তা মূলত মেডিক্যাল সায়েন্সের অতি সাম্প্রতিক গবেষণা বা ফলাফলের ওপরে ভিত্তি করে। আমি প্রফেশনাল টার্ম ব্যবহার করি; আমি এটাও জানি বাংলা ভাষায় পড়েও মানুষ ভুল বোঝে। যেমন, আমি লিখলাম “পরকীয়া অনৈতিক, কিন্তু অপরাধ তো না” আর বেশিরভাগ লোক মনে করলেন, আমি পরকীয়া সমর্থন করছি অপরাধ না বলে। অপরাধ হলো যা আইন দিয়ে শাস্তিযোগ্য, আর অনৈতিক হলো সামাজিকভাবে নীতিবর্হিভূত কাজ। আপনারা জেনে অবাক হবেন, বাংলাদেশের আইনে পরকীয়ার জন্যে পুরুষ শাস্তি পায়, কিন্তু মেয়েরা অপরাধী না!
হ্যাঁ, এখানে বৈষম্য আছে। এটা মেয়েদের জন্যে অসম্মানেরও; কারণ, বলা হয়েছে, মেয়েদেরকে সিডিউসড করা হয়। মেয়েরা যে পূর্ণ মানুষ তাই-ই মনে করা হয় না। যাই হোক, এই ভূমিকার পরে প্রথম পর্ব, আত্নহত্যা নিয়েঃ
পর্ব এক: আত্মহত্যা কী এবং কেন?
আত্মহত্যা হলো একজন ব্যক্তির সরাসরি ভায়োলেন্স বা অন্য উপায়ে নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৮০০,০০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন। গত ৪৫ বছরের পৃথিবীব্যাপী ৬০% আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। আত্মহত্যা সবচেয়ে বেশি হয় পূর্ব-ইউরোপীয় দেশগুলোতে। ছোট, বড়, ধনী, গবীর, ছেলে, মেয়ে, শাদা কালও বাদামি সকল গোত্রের মধ্যে আত্মহত্যার নজির দেখা যায়। তবে মূলত ১৫-২৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হলেও খুব পরিস্কার করে যতোটুকু জানা গেছে তাই-ই যথেষ্ট যে সুইসাইড একটি রোগ। একারণেই বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী সকল মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা আত্মহত্যাকে একটি রোগ হিসাবে মানসিক রোগের আকরগ্রন্থ “ডিএসএম-৫” এ অন্তর্ভূক্তির সুপারিশ করেছেন।
আত্মহত্যার রিস্ক ফ্যাক্টর কী কী? মনে রাখবেন রিস্ক ফ্যাক্টর মানে যেগুলো থাকলে আত্মহত্যা বেশি হয়।
১। আগে যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে
২। বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগ থাকা, যেমন, বাইপোলার, স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি।
৩। ড্রাগ বা অন্যান্য নেশায় আসক্তি
৪। পরিবারের মধ্যে যদি আত্মহত্যার ইতিহাস থাকে
৫। ছোটবেলায় যদি কোন রকমের এবিউজের হিস্ট্রি থাকে।
৬। আত্মহত্যার উপায় হাতের কাছে থাকা (যেমন, ডাক্তারদের কাছে সহজেই ওষুধ থাকে যা দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারে, কিম্বা যাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, আমেরিকায় প্রায় সকলের কাছে থাকে, এইজন্য সুইসাইড বেশি হয়)
৭। বড় ধরনের স্বাস্থ্যগত রোগ, যেমন ক্যান্সার বা পেইন
৮। নিকটজন বা বিখ্যাত কেউ আত্মহত্যা করলে
৯। ১৫-২৪ বছর এবং ৬০ বা তারচেয়ে বেশি বয়স্ক হলে।
সুইসাইড ব্রেইন কী?
মানুষের মস্তিষ্কে থাকে নানান রকমের নিউরোট্রান্সমিটার বা এক ধরনের ক্যামিক্যাল। গাবা (GABA) হলো সেই রকম একটি, যার কাজ মস্তিকের সামনের দিকের অংশ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, আপনি কী করবেন আর করবেন না তা নিয়ন্ত্রণ করা। গাবা অনেকটা ব্রেক সিস্টেমের মতো কাজ করে। অতিরিক্ত ভাবনা এলে, বা উলটাপালটা করতে চাইলে গাবা জানিয়ে দেয় যে ব্রেক ধরো।
দেখা গেছে, যারা বিষণ্ণতায় ভোগে তাঁদের এই গাবার কাজকর্ম এলোমেলো হয়ে যায়। এঁদের মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ধরনের রিসেপ্টর থাকে। এভাবেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে ব্রেক নিতে পারে না এরা। আরও আছে সেরেটোনিন। তাহলে আত্মহত্যা এমন একটি রোগ যা নিয়ন্ত্রণ করতে সত্যিকারের ভালো ডাক্তার প্রয়োজন। তাই যদি ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা বা অন্য মানসিক রোগ থাকে তাহলে সেটার চিকিৎসা জরুরি।
এখানে অনেকেই প্রশ্ন করেন যে বংশগত ব্যাপারটা কী? আসলে তেমন কোন জীন আবিষ্কৃত হয়নি, তবে এপি জিনেটিক যার অর্থ হলো, বাচ্চা যখন মায়ের পেটে তখন কী পরিবেশে মা থাকছেন এগুলো প্রভাব বিস্তার করে।
তাহলে জানা যাচ্ছে যে জ্বর হলে যেমন ওষুধ খাই, বা ডায়াবেটিস হলে যেমন সারাজীবন চিকিৎসা নিই, তেমনি যেকোনো মানসিক রোগের জন্যেই চিকিৎসা নেয়া উচিত। মানসিক রোগীকে পাগল বলবেন না। গালি দেবেন না, তিরস্কার করবেন না, ব্যঙ্গ করবেন না। বরং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন।
বিশ্বাস করুন আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে শুধু কথা বলে, পরামর্শ দিয়ে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছি অনেককে, যারা আমার এই ফেসবুকেও আছেন বন্ধু হয়ে। আবার ছোটবেলায় হারিয়েছি চেনাজানা অনেক মানুষকে। আপনিও পারেন আরেকজনকে বাঁচাতে। আসলে প্রতিটি মানুষই অপেক্ষা করে কেউ এসে তাঁকে বাঁচাক।