পরকীয়া ও আত্মহত্যা, কোনটাই মহান না

ডা. নাজিয়া হক অনি:

দুটি কাজের কোনটাই মহান কোন কর্ম না। দুটোই কাপুরুষোচিত কাজ। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে দুটি কাজই অত্যন্ত অপছন্দের। এবং সৃষ্টিকর্তার কাছেও।

আমি কোন বিশাল বাক্য বিন্যাসে যাবো না, খুব সহজ ভাষায় অল্প কয়টা কথা বলি। কারন আমি জানি আর সবকিছুর মতো এটাও ফেসবুকের আরেকটি হুজুগে যথারীতি তলিয়ে যাবে।

১) প্রথমে ডাঃ মিতুর পরকীয়া নিয়ে বলি। এই মেয়েটা ডাক্তার। সে কোন আক্কেলে এরকম মেরুদণ্ডহীন কাজ করেছে আমি জানিনা। কারন যতদুর জানি ডাক্তারি পড়তে এবং পাস করতে কিছু মগজ থাকা লাগে, সেই মগজ এর নিচে একটা মেরুদণ্ড না থাকলে মগজ তো অনেক আগেই খুলে পরে যাবার কথা। ওর মেরুদণ্ড যে নাই সেটা প্রমান করেছে এই ঘিলুলেস কাজটা করে।

কী কাজ?

তুমি বিয়ের আগে প্রেম থাকা অবস্থায় আরেকজনের সাথে পীরিত করতে গেলা কেন? আচ্ছা গেলা তো গেলা আবার ধরাও পরলা, মাফ চেয়ে হাতে পায়ে ধরে আবার ঐ প্রেমিককেই বিয়ে করলা? কেন? সাইড থেকে যাদের সাথে প্রেম করেছিলা, তাদের কাউকে মনে ধরে নাই বিয়ে করার জন্য? নাকি বিয়ে শুধু করার জন্যেই করলা? নয় বছরের প্রেম আফটার অল। কে, কী বলবে রাইট? এইজন্যে বিয়ের পর এক বছর মোটামুটি ভালো থেকে আবার যে কাজ তা শুরু করলা। জোস!!!

once a cheater, always a cheater, একবার যে চুরি করে, বারবার করে।

অনেকে এই লজিক দিচ্ছেন, ছেলের হয়তো কোন সমস্যা ছিল, আরে ভাই সমস্যা তো ছিলই, ছেলের মধ্যে ছিল নাকি ওদের নিজেদের বোঝাপড়ায় ছিল সেটা জানি না, তবে ভালবাসা বলে কিছু ছিল না এই মেয়ের ঐ ছেলের জন্য, থাকলে বিয়ের আগে চিট করতো না। মিতুর ভালবাসা আকাশের জন্য অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মিতু যে কোন কারণেই হোক কেবল নয় বছরের সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি। আর এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ভুল এই মেয়ের। এই ভুলের মাশুল এর পরে সে নিজে দিয়েছে এবং শেষমেষ তার জীবনসঙ্গীকে দিতে হয়েছে।

২) ডাঃ আকাশের আত্মহত্যা। এটা কেউ একদিনে করে না। নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তা একবারে একরাতে এই মানুষটার মাথায় আসে নাই। সে যেমনই হোক, যত দোষই থাকুক তার সে যখন দেখল তার প্রেমিকা বিয়ের আগেই তার সাথে চিট করেছে ঐখানেই সম্পর্ক ফুলস্টপ দেয়া দরকার ছিল। ফুলস্টপ দিতে পারে নাই। মাফ করে দিল, মাফ করলেও আবারও যখন একই রকম ঘটনা ঘটতে থাকলো, ছেলেটা আর নিতে পারে নাই।

দিনের পর দিন একটা মানুষ যদি একই রকম কষ্ট পেতে থাকে, আর সেটা কারো সাথে না বলতে পারে, কোন সমাধান না বের করতে পারে, তবে তার মানসিকভাবে সুস্থ থাকা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর এই অসুস্থতা নিয়ে দিনের পর দিন জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, হতাশা একসময়ে তাকে বাধ্য করে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে।

আকাশ নিজে যেমনই হোক, যাই হোক, সে যে মিতুর কাজকর্মে কষ্ট পাচ্ছিল, এর জন্য তার আরও অনেক আগে থেকে সচেতন হওয়া দরকার ছিল। একজন ডাক্তার হয়েও নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তার অসেচতনতা এবং আমি আরও বলব তার আশে পাশের মানুষদের কেয়ারলেস এই ঘটনা ঘটার জন্য অনেক দায়ী।

একটা কথাই আছে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। নিজের চেয়েও বেশি হয়ত ভালবাসত মিতুকে। এই ব্যাপারটাই ভুল। নিজের চেয়ে বেশি যদি কাউকে মানুষ ভালবাসে, তার পরিণাম ভাল হয়না কোনদিন। আমি নিজে ভাল না থাকলে আরেকটা মানুষকে কীভাবে ভাল রাখব?

ডা. আকাশ একটি কাপুরুষের মতো কাজ করেছে যারা বলছেন, তারা কেউ তার ভিতরের কষ্টটা হয়তো ধরতে পারছেন না। এই কষ্ট তার একদিনে তৈরি হয়নি। এবং খুব কষ্ট লাগলেও সত্য এই পরিণতির জন্য অনেকটা তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতা দায়ী। যে মানুষ তাকে ভালবাসে না তা একবার দেখিয়ে দিয়েছে ঐ মানুষের কাছ থেকে নিজেকে তার অনেক আগে সরিয়ে নেয়া দরকার ছিল। পারেনি।

though a tumor is part of ur body, u still need to cut it to save urself from the risk of cancer.
এই কাজটাই আকাশ পারেনি। পারলে আজকে হয়ত এই কারনে ছেলেটা নিজেকে শেষ করে দিত না। কয়েকদিন, কয়েক মাস হয়ত প্রেমিকার জন্য মন খারাপ থাকত, তবে বেঁচে থাকত।

৩) কখনও সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কোন ব্যক্তি প্রবেশ করার অর্থ হলো ঐখানে একজন সঙ্গীর ভালবাসা আর আগের মতো নাই, কমে গিয়েছে অথবা শেষ হয়ে গিয়েছে। তবে ভালবাসার চাইতেও আরেকটি বড় ব্যাপার আছে। কমিটমেন্ট, ওয়াদা, অঙ্গীকার।

হ্যাঁ, আপনার কাছে আপনার স্বামী/ স্ত্রী/প্রেমিক/ প্রেমিকাকে ভালো নাই লাগতে পারে একদিন হঠাৎ করে অথবা অনেকদিন দুজনের মধ্যে কোন সমস্যার কারণে, কিন্তু এর মানে এই না আপনি টুপ করে আরেকজন এর সাথে ঝুলে পড়বেন। যদি ঝুলতে হয়, একটা সম্পর্ক শেষ করে আরেকটাতে ঢুকুন, যদি একসাথে পাঁচজনের সাথে প্রেম করতে ইচ্ছা হয়, তবে পাঁচজনকে একসাথে জানিয়ে ক্লিয়ার করে প্রেম করুন যে, ভাই আমি সবাইকেই ভালবাসি, সবাইকেই চাই, তোমাদের সম্মতি থাকলে আসো, থাকো, না থাকলে দূরে গিয়ে মর।

কিন্তু এই যে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা, পরকীয়া করা, এটি ভালো না খারাপ তা আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে একে অত্যন্ত অপছন্দ করি আমার নাক উঁচা স্বভাবের কারণে। আমার নাক এমনই উঁচা যে নিজের সঙ্গী থাকা অবস্থায় আরেকজনের সাথে লুকিয়ে প্রেম করবো, এটা করতেও আমার অহমিকাতে বাঁধে।

আমার কাছে যে যত কিছুই বলুক পরকীয়ার সাফাই গাইতে, এটা একটা চুরি ছাড়া কিছু না, তাও ছিঁচকে চুরি। নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান থাকলে কেউ এই কাজটা করতে পারে না।আমাদের সমস্যা হল আমাদের আত্মসম্মান বোধ কোথায় মরেছে তা আমরা জানি না।

খুব বিরক্ত লাগলো কিছু মানুষ যখন নারীবাদ এর সাথে পুরো ব্যাপারটাকে মিশিয়ে ফেলছে। নারীবাদ মানে কি সঙ্গীকে চিট করে ১০ জন এর সাথে প্রেম করা? কোন ক্ষেতের উর্বর ঘাস খেয়ে এমন থিওরি মাথায় আসে আমি জানি না। এদের নিয়ে নতুন কিছু বলার নাই। আবাল কিছু চিরকালই ছিল, থাকবে।

৪) ডা. মিতু তার কমিটমেন্ট ভেঙ্গেছে অনেক আগেই, তার ভালবাসা থেকে, তার সঙ্গী থেকে। আর ডা. আকাশ কমিটমেন্ট ভেঙ্গেছে স্রষ্টার সাথে এবং নিজের আত্মার সাথে। দুজনেরই সাহসের অভাব ছিল, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহসের অভাব ছিল। দুটি কাজের কোনটিই সমর্থনীয় নয়।

দুইজন ডাক্তার এরকম কাজ করার পর প্রথম চিন্তা যা আমার মাথায় আসে তা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমরা কতটুকু অসচেতন। এবং ডাক্তার হবার পরেও তাদের নিজেদের মধ্যেও এই ব্যাপার নিয়ে কোন ধরনের চিন্তা কাজ করেনি। করলে এতোদূর হয়তো সমস্যা গড়াতো না।

এখন যা হয়েছে হয়েছে। খুব হতাশার মাঝেও আশা করব অন্তত আগামি দিনে যেন ডাঃ আকাশের মত কাউকে এভাবে কষ্ট পেতে না হয় এবং ডাঃ মিতুকেও যেন কাউকে এমন ভাবে চোরের মত থাকতে না হয়। কিন্তু এই আশা তখনই পুরন হবে যখন আমাদের সমাজ পরিবর্তন হবে। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। জাজমেন্টাল মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক, কারো কষ্টের সঙ্গী হওয়া যায় না। এইটুক যেদিন সবাই বুঝবে, সেদিন হয়তো একটা পরিবর্তন আসবে।

শেয়ার করুন: