#মিটু: কথা বলতে থাকুক মেয়েরা, সচেতনতা বাড়ুক

সোমা দত্ত:

বাড়িতে বাড়তি লোকের আনাগোনা একদম সহ্য করতে পারে না অপলা। কী এক কষ্ট যেন ওকে তাড়া করে বেড়ায়। এ নিয়ে মায়ের সাথে বাকবিতণ্ডাও কম হয় না! মা যতোই বলে, “তোর অসুবিধাটা কী, কেউ এসে দুই একদিন থাকলে তোর সমস্যাটা কোথায়?” তখন দেয়ার মতো উত্তর খুঁজে পায় না অপলা। মাকে তো ও আজও বলতে পারেনি, ছোটবেলার সেই দুঃসহ সময়ের কথাগুলো!

যৌথ পরিবারে অনেক মানুষের ভিড়ে অপলার বেড়ে ওঠা। খুব বেশী আদর – ভালোবাসায় না হলেও কড়া শাসনের মাঝেই কেটেছে ওর শৈশব-কৈশোর। মা-বাবার তেমন নজরদারি না থাকলেও, খবরদারি করার অন্য লোকের অভাব ছিল না। সারাদিন গৃ্হস্থালী কাজে ব্যস্ত মা আর পারিবারিক ব্যবসায় ব্যস্ত বাবা চাইলেও হয়তো সময় দিতে পারতো না ওকে।

ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ অপলা ভয় আর আতংকে মাঝে-মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলতো, তখন ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত ওর। আর মেজাজটাও খুব খিটখিটে হয়ে যায় তখন। খুব রাগ লাগে নিজের উপর, সেইসাথে কেমন যেন গা ঘিনঘিন করতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু না অপলা নিঃশব্দে কাঁদে, পাছে কেউ যদি কারণ জানতে চায়!

মেজাজী আর রুক্ষ স্বভাবের বলে অপলাকে নিয়ে অনেকেই কানাঘুষা করে। মা বাবাও বেশ বিরক্ত হয়। বয়সে বড় কারো সাথেই ঠিকমতো কথাও বলে না অপলা, বেয়াদবি করে বসে কখনও কখনও। ঘেন্না লাগে ওর, ভীষণ। মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে, কখনও আশেপাশের সবাইকে।

সোমা দত্ত

বাইরের মানুষজন বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন একেবারেই সহ্য করতে পারে না অপলা। বাড়ির বাইরে থাকলেই বরং ভালো থাকে ও। স্বভাবে চুপচাপ হলেও বন্ধুদের সাথেই ভালো সময় কাটে ওর, যদিও ছেলে বন্ধুদের সাথে খুব একটা সখ্যতা হয়ে ওঠেনা ওর নিজের কারণেই। ইতস্ততা, অস্বস্তি আর উৎকণ্ঠা অপলাকে সহজ হতে দেয়নি কখনো।

অপলা বড় হতে হতে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হতে থাকে ওদের বাড়িতে। পরিবর্তন হয় না শুধু অপলার মনের। মনের কোণে সেই কাটা দাগ নিয়ে চলেছে আজও। ছোটবেলায় সেই সময়ে শুধু ঘুমাতে যাওয়ার ভয়ে আতংকিত থাকতো অপলা। বড় হতে হতে সবকিছু স্পষ্ট হতে থাকে ওর কাছে।

বাবা-চাচা-ফুপু ও তাদের পরিবার ছাড়াও আরও বাড়তি দুই একজন কাছের ও দূরের আত্মীয় মোটামুটি স্থায়ীভাবেই সেইসময় অপলাদের বাড়িতে থাকতো। এরমধ্যে সবচেয়ে কাছের ছিল ওর বাবার নিজের ছোট চাচা, যাকে ও দাদু বলে ডাকতো। অপলার নিজের দাদু মারা গিয়েছিলেন ওর চার বছর বয়সে।

খুব বড় বাড়ি না হলেও, এতো মানুষজন নিয়ে একসাথে থাকা খাওয়ার মতো বড় মাপের মন ছিল ওদের বাড়ির সকলের। ছোট ভাই অন্তু হওয়ার পর মার সাথে আর জায়গা হলো না অপলার। বাড়িতে বড় ছেলেমেয়েদের জায়গা নিশ্চিত করে সাত বছর বয়সী অপলার ঘুমানোর জায়গা মাঝে-মাঝেই দাদুর পাশে হতো, ছোট বাচ্চা মেয়ে বলেই হয়তো! পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে পরা অপলার প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেতো ওর ছোট্ট প্যান্টের ভিতরে কারোর হাতের স্পর্শে।

অজানা, কিন্তু চেনা এক স্পর্শানুভূতির আতংকে ঘুম ভেঙেও চুপসে থাকা। ভয়ে ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পরা। পরদিন লজ্জায় কারুর দিকেই না তাকাতে পারা, মনমরা হয়ে সারাদিন চুপ করে থাকা। সেইদিনগুলি অপলাকে এখনও কাঁদায়। কাঁদায় সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটির অসহায়ত্বের কথা ভেবে, কাঁদায় নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর নির্দয় এক লোকের নিকৃষ্টতম কাজের অংশ মনে করে।

আজ অব্দি কাউকে বলতে পারেনি অপলা এই অপমান আর শোষণের কথা। খুলতে পারেনি মুখোশ পরা মানুষের আসল রূপ। লজ্জা আর ভয় গ্রাস করে ছিল সেই অবুঝ সময় থেকেই। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা ভেবে নিজেই কুঁকড়ে আছে এতকাল। আর মানুষের প্রতি অবিশ্বাসকে বাড়িয়ে থমকে আছে এখনও।

এমন বলতে না পারার কষ্ট বয়ে বেড়ানোর চাইতে কষ্টসাধ্য কিছু খুব কমই আছে এই পৃথিবীতে। ছোটবেলা থেকে দুঃখ কষ্ট গুলে খাওয়ার শিক্ষায়, মেয়েদেরকে এই নিদারুণ দহনেও পুড়ে বাঁচতে হয়। কারো প্রতি তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা আর রাগ পুষে চলতে চলতে, যদি একজনের কাছেও সেই ভয়ার্ত, অপ্রত্যাশিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা বলা যায়, তাতে যে মানসিক তৃপ্তি আসে, তা বুক ভরে বেঁচে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন। এই যে মনের ভিতরে চাপা দিয়ে বা অবদমন করে রাখা বিষয়টা হঠাৎ করে কাউকে বলতে পারার এই প্রক্রিয়াকে ভেন্টিলেশন (Ventilation) বলা হয়।

তাই চলুক এই #মি টু প্রক্রিয়া। এতে ১/২ জনকে না, জানানো যাচ্ছে পৃথিবীময়। আর গড়ে উঠছে সচেতনতা। যৌন নির্যাতন ও শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা গড়ে তোলাই হয়ে উঠুক মি টু’র প্রধান উদ্দেশ্য।

#MeTooBangladesh

লেখক: মনোবিজ্ঞানী

শেয়ার করুন: