ঈদ কেন সবার নয়?

মৌমিতা আলম:

ধর্ম যার যার, উৎসব সবার – এই বাক্য মেনে চলা বাঙালিদের ঈদ উৎসবে একরকম উদাসীন গম্ভীরতা লক্ষ্য করা যায়। ফেসবুক বা হোয়াটস আপ এ ঈদের শুভেচ্ছা জাতীয় পোস্ট বা মেসেজ দু একটা এলেও, যা আজকাল কমতে শুরু করেছে, ঈদ নিয়ে সেটা উন্মাদনা বা নিদেনপক্ষে সামগ্রিক সামাজিক উৎসবের পর্যায় এ পৌঁছয় না। দু একজন উৎসাহী, আন্তরিক বন্ধু “বিরিয়ানি খাওয়াও” জাতীয় দাবি করেন। সেটা ভালো লাগে, কিন্তু এই দাবির মধ্যেই পড়শীকে না জানার এক তীব্র নগ্ন বহিঃপ্রকাশ আছে। পশ্চিমবঙ্গের নব্বই শতাংশ মুসলিমদের ঈদে না আছে বিরিয়ানি খাওয়ার রীতি, না আছে সামর্থ্য। তাই বিরিয়ানির দাবি অনেকটা ঠিক পাতলা মুসুর ডালের সাথে পোলাও খাওয়ার মতো বেমানান, বেখাপ্পা। বাঙালি মুসলিম ঈদে সেমই, লাচ্ছা, পায়েশ,আন্দোশা পিঠে, বোদে খায়। আমার পূর্বপুরুষরা দই, চিড়ে কলা খেত। সেখান থেকে বাড়িতে বানানো সাদা মোটা সেমই এলো। আর এখন লাচ্ছা সেমই। সাথে লুচি কিংবা পরোটা। রাতে সামর্থ্য থাকলে পোলাও – মাংস না হলে মাছ – ভাত। আর পোলাও বিষয়টিও বেশ গোলমেলে। মালদার পোলাও সাদা, আর জলপাইগুড়ি র পোলাও মানে “নাল ভাত”(লাল ভাত)! সেখানে বিরিয়ানির স্থান বাড়ির উৎসাহী মেয়ে বা বৌমার ইউটিউব দেখে বিশেষ দিনে রান্নার শখ পূরণের সফল অথবা বিফল প্রচেষ্টা মাত্র।
বাঙালি মুসলিম মানেই বিরিয়ানি আর ইফতার মানেই জাকারিয়া স্ট্রিট – এই আবর্তেই আটকে থেকে বাঙালি আজ পড়শী যা খায় না তার দাবি করছে। কেন এই অজানা, অচেনা এত কাছে থেকেও?

১৯৪৭ এ দেশভাগের বলি হন প্রায় কুড়ি লাখ মানুষ। পশ্চিমবাংলার দুটো মূল সম্প্রদায়ের (ধর্মীয় ভিত্তিতে) মানুষদের প্রতিটি বাড়িতে আছে এপার থেকে ওপারে চলে যাওয়ার গল্প বা ওপার থেকে এপারে আসার গল্প। ভিটে মাটি হারানোর গল্প। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান দের জীবন ও বাঙালি মুসলিমদের জীবনে দেশভাগের ক্ষত নিয়ে লেখা গল্পের সংখ্যা কত?

দুর্গা পূজার পরেই বাঙালিদের মূল উৎসব হওয়ার কথা ঈদ। শুধু এই ঈদকে কেন্দ্র করে কোনো সিনেমা কি হয়েছে আজ অবধি? ঈদ পালনের খবর যখন দেখানো হয় টিভিতে, পর্দায় ভেসে ওঠে সেই একই ছবি বছরের পর বছর- কোনো এক মসজিদে সারি করে লোক ঈদের নামাজ পড়ছে আর এক দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক কোলাকুলি করছে বা দুজন বাচ্চা কোলাকুলি করছে। তথাকথিত মেইনস্ট্রিম কাগজগুলোর ঈদ উপলক্ষে কি কোনো বিশেষ সংখ্যা বেরোয়?
বর্তমান সময়ে অনেক জায়গাতে মেয়েরাও জামাত করে নামাজ পড়ছে। তার ছবি অনুপস্থিত। এই “অনুপস্থিতির” দুটো কারণ হতে পারে – এক পড়শীকে না চিনতে চাওয়া বা ইচ্ছে করেই না চিনতে দেওয়া। আজকে যখন ক্রিস্টমাস বাঙালিদের নিজস্ব উৎসব হয়ে উঠেছে সেখানে ঈদ অনেক দূরে। ক্রমশ আরও দূরেই চলে যাচ্ছে। অজ্ঞ করে রাখলে সুবিধে অনেক। সেই অজ্ঞতার সুযোগে ভরিয়ে দেওয়া যায় – ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিষ। সেই বিষ পান করিয়ে মত্ত করে রাখা যায় আর লাভ হয় ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাওয়া লোকজনের। সেই ক্ষমতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, এ ক্ষমতা সাহিত্য, সিনেমা, গল্পে শুধুই নিজেদের ন্যারেটিভ চালানোর ক্ষমতালিপ্সা।

হিটলার ক্ষমতায় আসেন ১৯৩৩ এ। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ এর মধ্যে তিনি হত্যা করেন প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদিদের। সেই নারকীয় হত্যাকান্ড যাতে আবার না ঘটে, সেই হত্যাকান্ডের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন হিটলার পরবর্তী জার্মানির অনেক শাসক। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর কোনরাড এডেনুয়ার 1951 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান জাতির নামে চলা ক্ষমাহীন অত্যাচারের জন্য “moral and material indemnity” দিতে রাজি হন। জার্মানির হিসেব অনুযায়ী তারা ৯১.৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেন ইহুদি নিধন যজ্ঞের শিকার মানুষদের। কিন্তু আজ অবধি আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ব্রিটিশ দের ঘাড় ধরে দুশো বছরের অত্যাচারের জন্য “সরি” কথাটিও বের করতে পারিনি। স্বামী এহসান জাফরির(২০০২ গুজরাট দাঙ্গায় নিহত) হত্যার বিচার চাইতে আইনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হচ্ছে জাকিয়া জাফরিকে।

হোলোকাস্ট জার্মানির পাঠ্যবইয়ে অবশ্য পাঠ্য বিষয়। আমাদের পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন থাকলেও, দেশভাগের যন্ত্রণার গল্প নেই। যে রাগ, যে ঘৃণা আমাদের জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে থাকার কথা শুধু ব্রিটিশদের জন্য, সেই বিদ্বেষ আছে আমাদের পড়শীর জন্য। সেইজন্যই আমাদের সাদাত হোসেন মান্টোর তোবা টেক সিং কিংবা খোল দো পড়া হয় না। সাদাত হাসান মান্টোর গল্প নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে কোনো মেইনস্ট্রিম সিনেমা হয়েছে বলেও মনে পড়ে না। এক কবি বলেছেন , আমি তোমায় চিনি না তোমায় বন্ধু; কিন্তু তোমার দুঃখগুলোকে চিনি। এই দুঃখগুলোকে চিনতে পারার মধ্যে দিয়েই হতে পারে/পারতো প্রতিবেশী কে চেনা।

কিন্তু মুসলিম প্রতিবেশী দের দুঃখগুলোকে চেনাতে ব্যর্থ শাসক(সে যে দলেরই হোক না কেন) জিইয়ে রাখতে চায়/চেয়েছে বিদ্বেষ, ঘৃণার ঐতিহাসিক দায়ভার। তাই দেশভাগের হরর বা তীব্র যন্ত্রণার সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি প্রতিমুহূর্তে তুলে ধরতে কোনো মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা গড়ে উঠেনি। বদলে সময়ে সময়ে তুলে ধরা হয়েছে শাসকদলের সুবিধামতো সিলেক্টিভ কিছু ঘটনার কিছু বিবরণী। যে বিবরণীতে রাজশাহী থেকে এপারে আসা নিমাইয়ের কষ্ট আছে কিন্তু আব্দুলের ভাই, যে সব ছেড়ে এপার থেকে ওপারে চলে গেল,থেকে গেল শুধু আব্দুল একা, তার/তাদের কষ্ট থাকলো অজানা, অচেনা। অচেনা থেকে গেল স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ঘটা দাঙ্গার ফলে internal migration এর যন্ত্রনায় ভোগা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষগুলোর যন্ত্রণা।

আর এই অজানা, অচেনার অন্ধকার অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর বেশ চলছে রাজনৈতিক ব্যবসা। যা এখন ফুলে ফেঁপে পচন ধরাচ্ছে আমাদের সোনার বাংলায়। আর সেই পচন গ্যাংগ্রিন হওয়ার আগেই চিনে নিতে হবে প্রতিবেশীকে। যে প্রতিবেশী এখন সরে যেতে যেতে যেতে ঠাঁই পেয়েছে শহরের ঘেটো তে। বাড়ির বাচ্চার প্রচণ্ড কাশি ছাড়াতে হিন্দু বাড়ির তুলসী পাতা আনতে, মুসলিম জরিনাকে আগে দু পা যেতে হতো। এখন মধ্যবিত্তর শহরে টোটো ভাড়া লাগে। ১৯৯১ পরবর্তী রাম মন্দির কেন্দ্রিক রাজনীতি মুসলিমদের ঘেটো, মহল্লার দিকে ঠেলে দেয়। আমার মেয়ে আর পাশের বাড়ির অমুসলিম বন্ধুর বাচ্চার খেলার স্পেস – যা ছিলো একে অপরকে জানার এক অন্যতম জায়গা তা কমতে থাকলো। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া আমার মেয়ের ‘পানি’ এখন water. তাই আমার বন্ধু সৌরভের ছেলে আর জানতে পারে না, আমার মেয়ের বাড়ির নিজস্ব ভাষা।
ক্যাপিটালিজম এর বাজারে তাই ক্রিস্টমাসের কেক, মোমবাতি আর টুপি আমার মেয়ে আর সৌরভের ছেলে দুজন জ্বালালেও, ঈদের আতর শুধুই টিমটিম করে শহরের প্রান্তরের মসজিদের দরজার পাশের ঝুপড়ি দোকানে।

সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আয়োজিত সর্বধর্ম সম্প্রদায়ের মিলিত ইফ্তার পার্টি নিয়ে বুদ্ধিজীবী মানুষদের মধ্যে চললো বিতর্ক। ক্যাম্পাসে ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠান করা উচিত কিনা সেটা নিয়েও চললো আলোচনা। সেটা সঙ্গত কারণেই। তবে যদি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পড়শীকে না চিনে, না মেনে, তার অনুষ্ঠানের, পরবের গুরুত্ব না বুঝে, তার রোজকার যাপনের অংশ না হয়ে পড়া যায়, তবে সব চেষ্টাই দাঙ্গা লাগার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার নামে মিছিল বের করার মতোই প্রায় মৃত গাছের আগায় জল দেওয়া বৃথা প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।

মন্টো চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে, কিন্তু রেখে গিয়েছিলেন তাঁর আত্মা ভারতে। তাঁর প্রাণের দেশ।

এ দেশ , এ রাজ্য আমাদের সবার। তাই দুর্গাপুজো যেমন সার্বজনীন। ঈদও হোক সবার। খুশির ঈদ। খোঁজ নিন প্রতিবেশীর। সবাই মিলে পাড়ায় একসাথে খাওয়া যেতেই পারে সেমই। যাতায়াত বাড়ুক। আসুন এই ঈদে আমরা চিনি, চিনতে শুরু করি এক অপরকে। বিশ্বাস গড়ে উঠুক। তবেই রেডিও রাওয়ান্ডার সুরে ২৪ঘন্টা যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে একদল মিডিয়া থেকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল, পারস্পরিক সম্পর্ক, সহযোগিতা, একে অপরকে চেনার মধ্য দিয়েই সেই ঘৃণা থেকে উত্তরণ সম্ভব। পড়শীর ঈদ হোক এবার আপনারও। ঈদ হোক সবার।

লালন ফকির তো কবেই বলে গেছেন,
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো, দূরে,
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো, দূরে।

মৌমিতা আলম
শিক্ষক

(লেখাটি আগে উত্তরবঙ্গ সংবাদ এ প্রকাশ হয়েছে। উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠকদের জন্য লেখাটি লেখকের অনুমতি নিয়ে পুন:প্রকাশ করা হলো।)

শেয়ার করুন: