শ্রাবণী এন্দ চৌধুরী:
একটু আগে লাইভ শুনছিলাম শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফ্ফার চোধুরীর কথা। তিনি বলছিলেন, একসময় বাংলাদেশে ছিলো ‘তোমার ধর্ম তোমার আর আমার ধর্ম আমার’। এই নিয়ে কোনো মারামারি, কাটাকাটি ছিলো না। আমার শৈশব, কৈশোর, রোকেয়া হলের দিনগুলোও এভাবেই কেটেছে।
আমার রুমমেট নামাজ পড়তো ঘরে। আমার টেবিলের উপর মা কালির একটা ছবি ছিলো। আমার রুমমেট কোনদিন আমাকে বলেনি, “এই ছবি সরিয়ে রাখ, আমার নামাজ হবে না”। ওর মাথায়ই ওই কথা আসেইনি। আমার সালমা মাসির (যাকে আমি আমার মা মনে করি) জায়নামাজে বসে ঘন্টা ধরে গল্প করেছি। আসলে সেই সময় এধরনের ভেদাভেদ ছিলো না। আজ আমি যা, সেটা হতে আমার বাবা, মা ছাড়া আমার এই মাসিমা, কাকাবাবুর অবদান অনেক।
আমরা যারা রোকেয়া হলে থাকতাম, সরস্বতী পুজোর সময় আমাদের অনুমতি ছিলো জগন্নাথ হলে যাবার। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। দল বেঁধে জগন্নাথ হলে যাওয়া। প্রতিমা সাজানো, ফল কাটা, লাইন দিয়ে অঞ্জলী দেয়া, আর তারপর দুপুরের খাওয়া। বিকেলে আবার যাওয়া, সন্ধ্যের সময় ফাংশন করে দল বেঁধে হলে ফেরা … এই ছিলো আমাদের সেই দিনের কর্মসুচি।
পুরোটা সময় আমাদের সাথে ডঃ জি সি দেব থাকতেন। মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটতেন! পুজোয় অন্যান্য মুসলিম শিক্ষকরা এবং ওনাদের স্ত্রীরাও থাকতেন। একবার আমাদের এক নামকরা শিক্ষয়িত্রী আমাকে হলে ফোন করে বলেছিলেন, ওনার মেয়ে, যে আমারই ক্লাসমেট, যেন সরস্বতী পূজোয় অঞ্জলী দেয় এবং পূজোর কাজে হাত দেয়। ও খুব চুপচাপ ছিলো। তাই ওর মায়ের চিন্তা ছিল যে, ও কিছু শিখছে না!
প্রতি পূজোয় আমার সাথে শামীম আর মনিকা থাকতো। শামীম বাড়ী থেকে আসতো। কোনদিন মাসিমা মেসোমশাই বলেননি, ‘পূজোয় যাবি কেন?’ পূজোয়, ঈদে, বড়দিনে দল বেঁধে শাড়ী কিনেছি। পরবর্তিতে রোকেয়া আর আমি ঈদে, পূজোয় একসাথে বেড়াতাম। রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ আমাদের দুজনকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন।
রোকেয়া হলের কাছেই ছিলো বুড়ো শিববাড়ী। শিবপুজোর দিন শিবের মাথায় জল ঢালার সময় রোকেয়া হলের মেয়েদের ভীড় ছিলো বেশি। রোকেয়া হলের মেয়েদের জন্য আলাদা লাইন হতো, কারণ তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
আমাদের মধ্যে সম্প্রীতি ছিলো অন্যরকম। আমরা নিজেদের নামে পরিচিত ছিলাম। ধর্ম দিয়ে নয়!
আমি সিলেটি। কোনদিন জলালী কবুতর খাইনি। কারণ শাহ্জালালের মাজারের কবুতর। আমার বাবা বারণ করেছিলেন। আজমীরে গিয়ে মাজারে গেছি। আবার আমার বন্ধু একবার কালিঘাটে গিয়ে কালিপূজো দিয়েছিলো। বিশ্বাস হলো যার যার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। ধর্ম এতো ঠুনকো নয় যে, কিছু হলেই “গেল গেল” রব ওঠে! মানুষ যতো শিক্ষিত হচ্ছে, গোঁড়ামি ততো বাড়ছে।
আমি এমন এক সময়ে জন্মেছি, যখন মানুষ ধার্মিক ছিলেন, ধর্মান্ধ ছিলেন না। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। আমি মানুষ হিসেবে জন্মেছি, মানুষ হিসেবেই চলে যেতে চাই।
(Published as part of Social Media Campaign #BeHumaneFirst to promote Secularism in Bangladesh)