নারী আম্পায়ারে সমস্যাটা কোথায়?

ফারদিন ফেরদৌস:

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
সেই কোন যুগেই কবি নজরুল সাম্যের কথা বলে গিয়েছিলেন, অথচ আমরা এতো বছর পরে এসে সেই সুবর্ণ দিনগুলো মুছে ফেলে নারকীয় কোনো‌ অন্ধকার অতলে তলিয়ে যাওয়ার সকল‌ আয়োজন সম্পন্ন করতে চলেছি!

যদি এমন খবর শোনেন যে মা, স্ত্রী, কন্যা ও বোন হিসেবে নারীকে মেনে নিচ্ছেন না বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে খেলা বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটার ও তাদের অধিকর্তারা! ব্যাপারটা কেমন শোনাবে না?
সত্যিকার অর্থে এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে ঘটতে কতক্ষণ?

বাংলাদেশে এখন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন প্রিমিয়ার লিগ চলছে। সেখানে একটা ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল প্রাইম ব্যাঙ্ক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। সেই ম্যাচ আয়োজনে দায়িত্ব পান দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক নারী আম্পায়ার সাথিরা জাকির জেসি। ICC-র স্বীকৃত আম্পায়ার তিনি। কিন্তু ওই ম্যাচ খেলতে অস্বীকার করেন দুই দলের ক্রিকেটার ও দলের কর্মকর্তারা।

২৫ এপ্রিল মিরপুরে শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মনিরুজ্জামানের সঙ্গে ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। নারী আম্পায়ার মিজ জেসি দায়িত্ব পেয়েছেন -এটা শুনেই রেগে আগুন হয় ম্যাচে অংশগ্রহণ করা ক্রিকেটাররা। যার ফলে ম্যাচ নির্ধারিত সময়ে শুরু হতে পারেনি। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কর্তারা মহিলা আম্পায়ার নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানায় আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যানকেও।

বিসিবি আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ মিঠু গণমাধ্যমকে জানান, প্লেয়ার ও অফিসিয়াল কর্তারা অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁরা মহিলা আম্পায়ারের নেতৃত্বে খেলবেন না। পরে তারা অবশ্য মেনে নেয় খেলার জন্য।

আচ্ছা আমরা দেখে নেই এই দুই দলে পরিচিত মুখ কারা খেলছেন।
তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের দল প্রাইম ব্যাংক এবং ইমরুল কায়েস, মাহমুদউল্লাহ ও মেহেদি হাসান মিরাজের দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।

মাহমুদুল্লাহ্, মুশফিক, তামিম ও মিরাজ আপনাদের কাছে প্রশ্ন, নারী যদি মা, স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নি এমনকি দেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার কিংবা সরকার প্রধান হতে পারেন, আম্পায়ার হতে বাধা কোথায়? আপনাদের জন্য যে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটারদের নিয়ে তীব্র কটাক্ষ ও নিন্দামন্দ হচ্ছে; সেটি কি অনুধাবন করতে পারছেন?

বিশ্ব ক্রিকেটে যেখানে মেয়েরা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে তাদের সাফল্য তাই প্রমাণ করছে, সেখানে বাংলাদেশের এই কয়েকজন ক্রিকেট খেলোয়াড় এবং কর্তাদের জন্য সমস্যা বাড়ছে। মানুষ হিসেবে আমাদের সবার এগিয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে আমরা ক্রমশ পেছনে ফিরছি। আইসিসি যেখানে নারী রেফারিকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটারের এমন নেতিবাচক ভূমিকা হতাশ করছে সবাইকে। নিন্দা হচ্ছে বিশ্বজুড়েই।

ফিলানথ্রোপিস্ট ও মানবতাবাদীরা বটেই, কোনো সুস্থ স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষ কিছুতেই ব্যাপারটি মেনে নিতে পারবে না। নারী ক্রিকেটে দিব্যি ছেলেরা আম্পারিং করছেন, কেউ কখনও প্রশ্ন তুলেনি, মেয়েরা কখনও বলেনি যে তারা পুরুষের অধীনে খেলবে না!

একমাত্র বাংলাদেশে নারীরা আম্পায়ারিং করলেই পুরুষদের সমস্যা? কেমন পুরুষ হে তোমরা? নারীর প্রতি এত ঘৃণা হৃদয়ের কোন নিকষ কালো অন্ধকার কুঠুরিতে পুষে রাখো তোমরা? নারীর উদরকে যখন নিজের আবির্ভাব কালে আঁতুড়ঘর বানিয়ে মায়ের দেহ মনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলে, কোথায় ছিল তোমার অহম? কোথায় ছিল তোমার আত্মম্ভরিতা? মাতৃস্থানীয়া সেই নারীকে নিজেদের সতীর্থ ও যথোচিত সম্মানের জায়গায় রাখতে না পারলে তোমাদের মানবজনমই তো বৃথা। নারীর এমনতর অবমাননায় লাগা নিজেদের ওপর শাপ ঘুচাবে কত জন্মে?

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ পাঠ তোমাদের জন্য অতি অবশ্যই জরুরি…

বেদনার যুগ,মানুষের যুগ, সাম্যর যুগ আজি,
কেহ রহিবেনা বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি!
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!
শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!

লেখক: সাংবাদিক
১৪ বৈশাখ ১৪৩১ | ২৭ এপ্রিল ২০২৪

#জয়নারী
#এগিয়েচলনারী
#মায়েরা_জিতলে_জয়ী_হয়_মানুষ

শেয়ার করুন: