কাকলী রানী দাস:
আমার বাবা চাকরি ব্যবসা দুইটা নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন। মা গৃহিনী, তবে শারীরিকভাবে বরাবরই বেশ রুগ্ন ছিলেন। তাই বিভিন্ন সময়ে মাকে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছুটতে হতো এবং বেশিরভাগ সময়ে বাবাও মায়ের সঙ্গে যেতেন। আমার বাবা-মায়ের অবর্তমানে আমরা চার ভাইবোন আমার বাবা মায়ের অতি বিশ্বস্ত (??) একজন কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে থাকতাম।
১৯৮৬–৮৭ সালের কথা বলছি। আমার বয়স তখন আট কী নয়। আমার ছেলে নীলের চেয়ে বছর এক দুইয়ের বড় হবো। তো এমনই একদিনে যখন আমার মা বাবা কেউই বাসায় নেই এবং দুপুরের খাবারের পর আমরা ভাইবোনরা সবাই একই রুমের দুটি বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছি। ঘুমের মধ্যেই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হলো। ঘুম ভাঙ্গতেই বুঝতে পারলাম আমার শরীরে একটা হাতের অনাকাঙ্খিত নড়াচড়া। কার হাত বুঝতেও অসুবিধা হলো না। কিন্তু তারপরও কী একটা দ্বিধা এবং ভয় আমাকে চুপ করিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ পর বাসার ভিতরে বিড়ালের প্রবেশ এবং কোন একটা ভারী জিনিসের পতনের শব্দ আমাকে সেই নরক যন্ত্রণা থেকে বাঁচালো।
এই ঘটনা ছাড়াও প্রায় কাছাকাছি সময়ে আরো দুবার ভিন্ন দুইজন পুরুষের দ্বারা এরকম দুঃসহ যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। এবং তারা দুজনেই আমাদের পরিবারের খুব কাছের বন্ধু। না, কখনই আমার এই যন্ত্রণার কথা মা বাবা বা অন্য কাউকে বলা হয়নি। কারণ আমি বলতে পারিনি। সব সময় মনে হয়েছে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং উল্টো আমাকেই দোষারোপ করবে।
হ্যাঁ, ঐ অতটুকু বয়সেও আমার এই বোধটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। সেই ছোট্ট আমি লুকিয়ে কাঁদতাম, নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতো। নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম সবার থেকে। মা-বাবা খুশীই হতেন, কারণ আমি নিজেকে সবার থেকে বিছিন্ন করে বইয়ের মাঝে লুকিয়ে ফেললাম। তারা মেয়ের অর্ন্তমুখিতার সুবিধাটাই সম্ভবত দেখেছিলেন, কিন্তু কখনও এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেননি। এই দুই বছর, তিন বছর আগ পর্যন্তও এই স্মৃতিগুলো আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। আজও আমি নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারি না, মাঝ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে জেগে উঠি। আমার মতো একজন আত্মবিশ্বাসী নারীকেও এই দু:স্বপ্নগুলো কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে দেয়।
না, এখানেই আমার যৌন হয়রানির ঘটনা বা দুর্ঘটনা শেষ হয়নি। এরপরও অসংখ্যবার নিউমার্কেট বা গাউছিয়ার ওভারব্রিজে, টিএসসির মেলার ভীড়ে, রিক্সায় যেতে যেতে, পাবলিক বাসে চড়ার সময় হাজারও বার এমন অনাকাঙ্খিত যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। এই চল্লিশ বছর বয়সেও যখন নিজেকে একজন দায়িত্বশীল মা, একজন পরিণত মানুষ মনে করি, ঠিক তখনই হয়তো আমার কোন সহকর্মী বা পরিচিত বা বন্ধু (??) আমার সাথে কথা বলাই শুরু করেন আমার বুকের দিকে তাকিয়ে, কিংবা মুখ থেকে দৃষ্টি একটু একটু করে বুকের কাছে এসে থেমে যায়। অনেকবার বলবো বলবো করেও এদেরকে কিছু বলা হয়নি। কারণটা তো জানাই – শেষে আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে যে আমার অভিযোগের ভিত্তি কী? কই, তারা অন্য নারীদের সাথে তো এমন করেন না!!!
নারীবাদী নারী হিসেবে এমনিতেই বাড়তি ঝামেলা আমার সঙ্গী, আর তারপর আবার ঘরে বাইরে ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে কেউ তো আমার কথা বুঝতেই পারবে না।
কিন্তু তারপরও এখন মনে হচ্ছে, আর কত? অনেক হয়েছে। এবার সময় এসেছে সবক্ষেত্রে যৌন হয়রানিকে পেশাদারিত্বের সাথে মোকাবিলা করার। প্রদীপের নিচের অন্ধকারটাকে গলা টিপে ধরার। নিজে যেই ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা যেন আর একটা শিশুকেও, একজন পরিণত নারীকেও বা অন্য কাউকেই পেতে না হয় – সেই পথ তৈরি করার।