হিন্দুদের বাসা ভাড়া দেই না

সেবিকা দেবনাথ: আমার ৩৬ বছরের জীবনে বাবুর (বাবা) চাকরি সূত্রে পাওয়া কোয়ার্টারেই কাটিয়েছি দীর্ঘ ২০ (১৯৯১ থেকে ২০১০) বছর। পাঁচ-ছয় বছর আগেও বাসা ভাড়া নেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে উদ্ভট সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি আমি।

পাঁচ বছর আগের একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই। গোপীবাগে থাকি। একই এলাকায় থাকবো, কিন্তু বাসা বদল করবো। সময় পেলেই ‘টু-লেট’ লেখা খুঁজতে বের হতাম। যখনই একটা ‘টু-লেট’ লেখা দেখতাম অমনি মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠতো। ‘পাইলাম আমি ইহারে পাইলাম’ সুখকর অনুভূতি জাগতো মনে। প্যাডে বিস্তারিত লিখে নিয়ে, ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা বের করতাম। উল্লেখিত নাম্বারে ফোন করে ভাড়া কতো, বাসা কতো স্কয়ার ফিট, কী কী সুবিধা আছে, কখন এলে বাসা দেখা যাবে, ইত্যাদি জানতাম। বিস্তারিত জেনে বাবুকে বলতাম।

সেবিকা দেবনাথ

কোনোটা ভাড়ায় বনতো না, কোনোটা গলির ভেতরে, কিংবা পাঁচ-ছয় তলা, কিন্তু লিফট না থাকায় বাবু-মা যেতে চাইতো না। এভাবেই দিন যায়, আমি বাসার খোঁজ আনি, আর সব বাতিল হয়ে যায়। অবশেষে পেলাম এক বাসার সন্ধান। গোপীবাগে নাসরা স্কুলের গলি’র ভেতরে। বিস্তারিত জেনে আমি আর বাবু গেলাম বাসা দেখতে। বাসা দেখে তো নয়ন জুড়ায়ে গেলো আমার। তিনটা বড় বড় বেড রুম। ড্রইং-ডাইনিং রুমও বিশাল। বাথরুম দু’টাও বড়। কত বড় টানা বারান্দা। লিফট নেই, কিন্তু বাসা তিনতলা, সমস্যা হবে না। ভাড়া ১৬ হাজার টাকা। গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল আলাদা।

মনে মনে বললাম, যাক বাবা, এতোদিনে মনের মতো একটা বাসা পাইলাম। ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ এ কথার সত্যতা পেয়ে আমি তো মহা খুশি। সন্ধ্যায় মা’কে নিয়ে বাসা দেখতে যাবো, আর সবকিছু ফাইনাল করবো এমন কথা বলে আমরা বাপ-বেটি বাসায় এলাম। সন্ধ্যায় মাকে নিয়ে গেলাম বাসা দেখতে। বাড়িওয়ালা বললেন, ‘আসেন ভেতরে আসেন’। আমরা ঢুকলাম। আমাদের পেছন পেছন মা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। মাকে (হাতের শাঁখা-সিঁদুর) দেখেই বাড়িওয়ালা বলে বসলেন, ‘আপনারা হিন্দু? আগে বলবেন না? আমি তো হিন্দু ভাড়া দেবো না।’

বলে কী লোকটা! এ কথায় যতোটা অবাক হয়েছি, রাগে গা রি-রি করছিলো তার চেয়ে ঢের বেশি। মা আর ভেতরে ঢুকলো না। বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি জোর গলায় বললাম, ‘এটা কেমন কথা? সকালে তো বলছেন আমাদেরই ভাড়া দেবেন।’ বাড়িওয়ালা, ‘হুম বলছি। তখন তো বলেন নাই, আপনারা হিন্দু।’ আমি, ‘আপনিও তো টু-লেটে বলেন নাই হিন্দু ভাড়া দেবেন না। হিন্দু হলে সমস্য কী?’

বাড়িওয়ালা, ‘সমস্যা আছে।’ আমি, ‘কী সমস্যা বলেন?’ বাড়িওয়ালা, ‘হিন্দুরা পানি বেশি খরচ করে। ধূপের গন্ধে অন্য ভাড়াটিয়াদের সমস্যা হয়।’ আমি, ‘ভাড়াটিয়ারা আপনারে সে কথা বলছে?’ বাড়িওয়ালা, ‘এতো কথার কাজ নাই, আমি হিন্দু ভাড়া দেবো না।’

ইতোমধ্যে মা আমার হাত টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। বাবু আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আমার তখন ওই লোকটাকে খুন করতে ইচ্ছা করছিলো। বললাম, ‘ঢাকা শহরে বাড়ি থাকলেই বড় লোক হওয়া যায় না। ছোট লোকদেরও বাড়ি থাকে।’ বাবু-মা সঙ্গে না থাকলে গায়ের ঝাল মিটিয়ে আরও কিছু কথা বলতে পারতাম। ওই ইতর লোকটার বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম।

এতো কথা কেন বললাম, সেজন্য মা আমাকে বকলো।

দ্বিতীয় ঘটনাটা বলি, গোপীবাগের ৪নং গলিতে একটা বাসা পেয়েছিলাম। ওটা দো’তলায়। বিশাল বড় বাসা। কথা বলতে বলতে বাড়িওয়ালির সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে গেলো। আমরা কে, কী করি সব শুনলেন। জানালেন, আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে উনার। সন্ধ্যায় অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তিপত্র হবে। বড় বাসা পেয়ে সবাই খুশি। বাবু-মা আর আমার ছোট মামা গেলো ওই বাসায়। বাবু-মা’কে খুব খাতিরদারি করলো।

বাড়িওয়ালা আবার জানতে চাইলো, আমরা ভাই-বোনরা কে, কী করি। বাবু বললেন, আমার বড় মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ইটালি থাকে। মেজো মেয়ে সাংবাদিক। সেজো মেয়ে বিসিএস-এর জন্য পড়ছে। ছোট মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর পড়ছে। (ওর তখনও ব্র্যাকে চাকরি হয়নি।) ছেলে কবি নজরুলে ইংলিশে অনার্স পড়ছে।

সব শুনে বাড়িওয়ালা বললো, ‘দাদা, একটা সমস্যা হইছে। যে বাসাটা ভাড়া দেবো ভাবছিলাম, সেখানে আমার মেজো মেয়ের জা ভাড়া থাকবে। তাই আর অন্য ভাড়াটিয়া দিতে পারবো না।’ আমার বাবু নিরেট ভদ্রলোক। আর কোন কথায় গেলেন না। বাসায় এসে সবটা বললেন। কয়েকদিন পর একটা সমস্যা নিয়ে বাড়িওয়ালি ফোন করলো আমাকে। তারও কয়েকদিন পর আমি গেলাম ওই বাসায়।

বাড়িওয়ালিকে বললাম, ‘খালাম্মা, আমাদের ভাড়া দিলেন না কেন? আপনার মেয়ের জা’তো বাসা ভাড়া নেয় নাই।’ বললেন,‘তুমি সাংবাদিক শুইন্না তোমার খালু ডরাইছে।’ বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন খালু, সাংবাদিকরা কী করছে আপনারে?’

উত্তরে বললো,‘সাংবাদিকরা ভাড়া দিতে চায় না। একবার ভাড়া নিলে হেরা আর বাসা ছাড়ে না।’ আমি, ‘ভাড়া দেয় না মানে? কী কন এইসব?’ বাড়িওয়ালা, ‘আমি শুনছি’। কথা বাড়াতে ইচ্ছা করলো না। বাড়িওয়ালি, ‘তুমি রাগ কইরো না, মা। আমাদের এই বাড়ি জ্বীনের বাড়ি। না নিয়া ভালোই করছো।’ বাড়ির সামনের নারকেল গাছটার দিকে আঙ্গুল তুলে উনি বলতে লাগলেন, ‘আমার আব্বা জ্বীন পালতো। এটা আমার আব্বার বাড়ি। আমার তো ভাই নাই। এই বাড়িটা আমি পাইছি। আব্বার পালা একটা জ্বীন এখনও এই বাড়িতে আছে। ওই গাছে থাকে।’

ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছোট বোতল দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখো ঘর বন্ধক দিয়ে রাখছি। দোতলায় আগে যে হিন্দু ভাড়াটিয়ারা ছিলো তারাও ওই জ্বীনের জন্য বাসা ছাড়তেছে। তোমরা যে ধূপ দেও, ওটা জ্বীন সহ্য করতে পারে না।’ হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না। তবে গল্পটা বেশ ভালো লাগলো। এরপর ওই বাড়ির নাম দিয়েছি, জ্বীন-ভূতের বাড়ি। এখনও এ ঘটনা আমাদের বাসায় হাসির খোরাক হয়।

এবার বলি সম্প্রতিক এক ঘটনা। ফেব্রুয়ারির ৩/৪ তারিখ গোপীবাগের বিন্দুর গলিতে ‘টু-লেট’ দেখে বাপ-বেটিতে গেলাম। সেটিও বিশাল বাসা। বাড়িটি যে ভদ্রলোকের, তিনি গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। ওই ভদ্রলোক গোপীবাগ বড় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। অত্যন্ত স্বজন বলে পরিচিত। এগুলো অবশ্য পরে জেনেছি। বাসা দেখতে গেলাম। চার তলা ভাড়া দেয়া হবে। চার তলায় যারা ভাড়া থাকতেন, তারা তিনতলায় চলে যাবেন। বাসা খুবই চমৎকার। লিফট নাই। ভাড়া ২২ হাজার। বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল আলাদা।

আমার কেন যেন সন্দেহ হলো। আগের ভাড়াটিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, ‘উনারা কি হিন্দু ভাড়া দেবেন?’ তিনি বললেন, ‘তা-তো জানি না। তবে খালাম্মা (বাড়িওয়ালি) একবার বলছিলেন, হিন্দু দেবেন না’। আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেলো। নিচে নামতেই বাড়িওয়ালির নাতির সাথে দেখা। যে সবকিছু দেখাশোনা করে। জানতে চাইলাম, হিন্দু ভাড়া দেবে কিনা! আমতা আমতা করে বললো, ‘নানি আমাকে তেমন কিছু বলে নাই। আমি দেখি।’ যা বোঝার বুঝে নিলাম।

পরে লোক মুখে শুনলাম, বাড়ির মালিকের ছেলে খালেদা জিয়ার বোনের মেয়েকে বিয়ে করেছেন। খালেদা জিয়াও নাকি ওই বাড়িতে কয়েক বার এসেছেন। আরও শুনলাম, উনারা কট্টর মুসলমান। তাই কখনও হিন্দু ভাড়া দেয় না। মোটা দাগের তিনটা ঘটনার কথা বললাম। বাসা ভাড়া খুঁজতে গিয়ে এমন আরও ঘটনা ঘটেছে।

অনেকে বলেছেন, ব্যাংকার না হলে ভাড়া দেবেন না। অনেকে বলেছেন, সরকারি চাকরিজীবী না হলে ভাড়া দেবেন না। কেউ বলেছেন, বাসায় বেশি অতিথি আসা যাবে না। গাড়ি নেই জানার পরও কেউ বলেছেন, গ্যারেজসহ ভাড়া নিতে হবে। কেউ বলেছেন, তারা ছোট ফ্যামেলি ভাড়া দেবেন। ঢাকা শহরের ভাড়াটিয়াদের এমন হাজারও রকমের অভিজ্ঞতা আছে, জানি।

বাড়ির মালিক কাকে ভাড়া দেবেন, সেটা অবশ্যই তার অভিরুচির ব্যাপার। সব মেনে নিলেও শুধুমাত্র ‘হিন্দু’ বলে ভাড়া না দেয়ার বিষয়টা কেন যেন হজম হতে চায় না। আর হিন্দু ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগগুলো শুনলে বড্ড বেশি হাসি পায়। হিন্দুরা বেশি জল খরচ করে। সকাল-সন্ধ্যা ওদের জ্বালানো আগরবাতি/ ধূপের গন্ধে অন্য ভাড়াটিয়াদের গা গুলায়।

হায়রে বাড়িওয়ালা! ভাগ্যিস ঢাকা শহরে তোদের একটা বাড়ি ছিলো!

শেয়ার করুন: