রেইনবো পতাকা, এলজিবিটিকিউ রাইটস ও বর্জনবাদ!

ফারদিন ফেরদৌস:

ঈদের আগে আগে নতুন ইস্যু হাজির হয়েছে। আড়ং এর খয়েরি পাঞ্জাবিতে কেন রংধনুর সিম্বল? বয়কট ফ্রান্স, বয়কট কোকাকোলা, বয়কট ইন্ডিয়ার পর এখন শুরু হয়েছে বয়কট আড়ং। কিন্তু গতকাল বিকেলে আড়ং – এ প্রবেশ করতে গিয়ে পর্যাপ্ত জায়গা পাইনি। মনুষ্য পদভারে গিজগিজে অবস্থা। জানি না বয়কটের ফলটা আসলে কী?

বয়কট কী? বয়কট কে?
ব্রিটানিকা ডট কম বলছে, বয়কট হলো একটি সম্মিলিত এবং সংগঠিত বর্জনবাদ যা শ্রম, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা অন্যায্য বলে গণ্য করা হয়। উচ্চ খাজনা এবং জমি উচ্ছেদের প্রতিবাদে ১৮৮০ সালের আইরিশ ভূমি আন্দোলনের সময় চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেল দ্বারা বয়কট জনপ্রিয় হয়েছিল। আইরিশ ভাড়াটেরা পার্নেলের প্রস্তাবিত আচরণবিধি অনুসরণ করার পরে এবং ব্রিটিশ এস্টেট ম্যানেজার, চার্লস কানিংহাম বয়কটকে কার্যকরভাবে বহিষ্কার করার পরে বয়কট শব্দটি তৈরি করা হয়েছিল।

প্রশ্ন হলো, এই ব্রিটিশ বয়কটকে আমরা আসলে কীভাবে বর্জন করতে পারি? আমরা তো একমাত্র নিজেদের সংস্কৃতি বা আচার আচরণকে বড় করে দেখি। এমন বাস্তবতায় আমাদের কালচারে বয়কট বেচারার থাকার অধিকার কি আদৌ আছে?

LGBTQ তথা “lesbian, gay, bisexual, transgender and queer (or “questioning”)রা রংধনুকে তাদের গর্বের পতাকা করে নিয়েছে বলে আমরা সাত রঙ একত্রে দেখলেই ক্ষেপে উঠছি। এটা কী করে হতে পারে?

এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অধিকারের পক্ষে সবচেয়ে সরব প্রভাবশালী ব্যক্তি হলেন ফেসবুকের কো ফাউন্ডার মিস্টার মার্ক জাকারবার্গ। কিন্তু বয়কটে নেটিজেন কোনোদিন ফেসবুক বয়কটের দাবি তুললো না। আচ্ছা এই সাত রঙ তো গুগল, গুগল ক্রোম, প্লে স্টোরের লোগোতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় অ্যাপ্লিকেশনস জীবন থেকে বাদ দিতে পারব তো?

সবচেয়ে বড় কথা মেঘ আর রোদের কারিকুরিতে আকাশে যে সাতরঙা রংধনু মাঝে মাঝে দেখা দেয়, ওইটাকে বর্জন করবার কোনো তরিকা আছে? যুক্তির কথা হলো হোমোসেক্সুয়ালরা মাকে মা, বাবাকে বাবাই বলে। আমরা কি তাহলে মা-বাবা উচ্চারণ করা বাদ দেব? ওরা যেভাবে পানাহার করে, আমরা প্রায় একই ধাচে খাবার গিলি। আমরা তাহলে ভিন্ন পথ ধরব? বাংলাদেশের কোনো শত্রুপক্ষ যদি বলে তারা আর লাল সবুজ ব্যবহার করবে না, সেটা কোনোপক্ষেই কি গ্রহণযোগ্য হবে?

আপনাদের স্বাধীনতা আছে, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার অস্বীকার করতেই পারেন, যদিও এই মুহূর্তে ৩৪টি দেশে সমকামী বিয়ে আইনসিদ্ধ। ব্রিটেন, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ সেসব দেশে মুসলিমরাও বসবাস করেন। এতই যদি বর্জনের ঝোঁক আমরা তবে ওসব দেশে পড়াশোনা, চাকরিবাকরি বা নাগরিকত্বের জন্য এত দৌড়ঝাঁপ পারি কী করে?

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় রংধনু পতাকার হিস্টরিটা জানিয়ে রাখি। ব্রিটানিকা ডট কমে Stonewall Riots লিখে সার্চ দিলে ১৯৬৯ সালের ২৮ জুন সকালে নিউইয়র্ক সিটির গ্রিনউইচ ভিলেজ সেকশনে স্টোনওয়াল ইনের গে বারের বাইরে গে রাইটস এক্টিভিস্ট ও পুলিশের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধার ঘটনাটি সামনে আসে। ওই দাঙ্গার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক গে রাইটস মুভমেন্ট জন্মলাভ করে। এর আগে হোমোসেক্সুয়াটি আইনসিদ্ধ একটিভিটিজ হিসেবে স্বীকৃত ছিল না।

পরবর্তীতে ১৯৭৮ শিল্পী গিলবার্ট বেকার যিনি নিজে একজন গে, তিনিই ওই রংধনু পতাকার ডিজাইন করেছিলেন। তিনি বলেন, সমকামী মানুষ হিসাবে আমাদের কাজ ছিল বেরিয়ে আসা, দৃশ্যমান হওয়া, সত্যে বেঁচে থাকা, যেমনটি আমি বলি, মিথ্যা থেকে বেরিয়ে আসা। একটি পতাকা সত্যিই সেই মিশনের সাথে মানানসই, কারণ এটি আপনার দৃশ্যমানতা ঘোষণা করার বা বলার একটি উপায়, ‘এই আমি কে!’”

বেকার আকাশের রংধনুকে একটি প্রাকৃতিক পতাকা হিসাবে দেখেছিলেন, তাই তিনি স্ট্রাইপের জন্য আটটি রঙ গ্রহণ করেছিলেন, প্রতিটি রঙ এর নিজস্ব অর্থ সহ (যৌনতার জন্য গরম গোলাপী, জীবনের জন্য লাল, নিরাময়ের জন্য কমলা, সূর্যালোকের জন্য হলুদ, প্রকৃতির জন্য সবুজ, শিল্পের জন্য ফিরোজা, সম্প্রীতির জন্য নীল এবং আত্মার জন্য বেগুনি)।

রংধনু পতাকার প্রথম সংস্করণ সান ফ্রান্সিসকো গে ফ্রিডম ডে প্যারেডের জন্য ২৫ জুন, ১৯৭৮-এ ওড়ানো হয়েছিল। বেকার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল তাদের হাতে তৈরি করেছিল। পরে উৎপাদনের সমস্যা বিবেচনায়, গোলাপী এবং ফিরোজা স্ট্রাইপগুলি সরানো হয়েছিল এবং নীলকে মৌলিক নীল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল, যার ফলে সমসাময়িক ছয় ডোরাকাটা পতাকা (লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল এবং বেগুনি) তৈরি হয়েছিল।

Britannica.com লিখছে, It was not until 1994 that the rainbow flag was truly established as the symbol for LGBTQ pride. That year Baker made a mile-long version for the 25th anniversary of the Stonewall riots. Now the rainbow flag is an international symbol for LGBTQ pride and can be seen flying proudly, during both the promising times and the difficult ones, all around the world.

সামগ্রিক আলোচনা থেকে
এটা আমরা বলতে পারি যে, বর্জনবাদের ধোঁয়া তুলে সিলেক্টিভ প্রতিবাদী হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। একটা নিরীহ পাঞ্জাবির সাথে না লেগে আমাদের বোধহয় আকাশের রংধনুকে বর্জন করার তরিকা খোঁজা উচিৎ। সেটা না পারলে উল্লেখিত ৩৪ দেশ বর্জনের ডাক দেয়া যেতে পারে। সেটাও সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে বদনবই বর্জন করে দেখান তো দেখি। কিছুই পারবেন না তো? তাহলে চুপ যান ভাইসকল।

লেখক: সাংবাদিক
৩০ মার্চ ২০২৪

শেয়ার করুন: