কর্মক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগ্রহণে কেন পিছিয়ে নারী

সাবরিনা শারমিন চৌধুরী:

প্রতি বছর নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি ও শ্লোগান নিয়ে নারী দিবস, নারীপক্ষ আসে, আবার চলেও যায়। দিবস চলে যাওয়ার পর আমরা সেসব প্রতিশ্রুতি ও শ্লোগান বিস্মৃত হয়ে আবারও সেই একই আবর্তে ঘুরতে থাকি। নারী দিবস বা নারীর অধিকার সংশ্লিষ্ট ইভেন্টগুলো শেষে আমাদের নারী কণ্ঠস্বর টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি চর্চার চাপে আবারও হারিয়ে যায়। এই ইভেন্ট কর্মসূচিগুলো চলাকালীন সময়ে সভা, সেমিনার, আলোচনার টেবিলে নারীদেরকে যত স্তুতিবাক্য ও প্রতিশ্রুতির জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তার কিছুটাও যদি বাস্তব চেহারা পেত, তাহলে দেশে আজ জেন্ডার বৈষম্যের চেহারা বদলে যেত। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আশা ও আশংকার মধ্যে আমাদের প্রাপ্তির হিসাব দুলতে থাকে।

আমরা দীর্ঘদিন ধরে চাইছি প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর সম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হোক। এ লক্ষ্যে নারীর জন্য পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশনের কথাও শুনে আসছি অনেকদিন ধরে। জেন্ডার বিষয়ক বক্তৃতা বা আলোচনার টেবিলে ‘পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন’ আজকাল একটি চমকপ্রদ স্মার্ট শব্দগুচ্ছ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরা জানেন যে বাস্তবে এই স্মার্ট শব্দগুচ্ছের বাস্তবায়নের হালচাল কেমন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর তথ্য অনুসারে দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬%। এরমধ্যে নারী শতকরা ৭২.৮২ ভাগ, যেখানে পুরুষের আনুপাতিক হার কিছুটা বেশি, ৭৬.৫৬%। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২১ এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার হার ৫৪.৬৭%, উচ্চ মাধ্যমিক ও তদূর্ধ্ব ৫০.৩৭%, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৫৪.২৮%, কারিগরি শিক্ষায় ২৭.১৩%, এবং চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিসহ অন্যান্য বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ৬২.৭২%।

অর্থাৎ তথ্য বলছে, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। আর মেধার কথা যদি বলি – আমরা প্রায় প্রতিবছর এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মেয়েদেরকে এগিয়ে থাকতে দেখি। পত্রিকার পাতা খুললেই পরীক্ষার ফলাফলে মেয়েদের সাফল্যের জয় জয়কার দেখি। মেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জনে পিছিয়ে থাকে না। শিক্ষাগ্রহণ শেষে এই মেধাবী মেয়েরাই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। অথচ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর এরা পিছিয়ে পড়তে থাকে।

কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর একটা নির্দিষ্ট ধাপের পর নারীরা এগোতে পারছে না। ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে পৌঁছুতে একজন নারী কর্মীকে কতভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হয় সেটি কর্মজীবী নারী মাত্রই জানেন। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়সারা গোছের একটা সাধারণ বক্তব্য হলো যোগ্য নারী পেলেই ঊর্ধ্বতন পদে নারী কর্মী নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া হবে। তারা যোগ্য ও দক্ষ নারী পাচ্ছে না। তাহলে এই যে শিক্ষায় এগিয়ে থাকা, পরীক্ষার ফলাফলে এগিয়ে থাকা নারীরা, এরা কোথায় হারিয়ে গেল? কোথায় হারিয়ে যায়? সবটা পথ এগিয়ে থেকে কর্মক্ষেত্রে এসে হঠাৎ কেন এই মেধাবী নারীরা পিছিয়ে যেতে থাকে পুরুষের চেয়ে? একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার অধিকারী হওয়া সত্বেও কোন বিশেষ দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে পুরুষকর্মীকে নারীকর্মীর চেয়ে শতভাগ এগিয়ে রাখছে? সেই দক্ষতা তারা কীভাবে অর্জন করছে? টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির ভারে নুয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর মেধা ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করতে চাইছে না। কেন? আমরা কখনও এসব প্রশ্ন করি না।

কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পদমর্যাদায়, সিদ্ধান্তগ্রহণ পদগুলোতে নারীর আসতে না পারার কারণ তার ব্যক্তিগত অযোগ্যতা নয়, বরং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যায্য নেতৃত্ব এবং পুরুষ অধ্যুষিত ম্যানেজমেন্ট ও প্রশাসনের বৈষম্যমূলক আচরণ নারীকর্মীর পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত নিম্নপদস্থ পদগুলোতে নারী কর্মীদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী থাকে। এতে ঐ প্রতিষ্ঠানে নারীকর্মীর মোট গড় সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নিয়োগ প্রদানের পর এসব নারী কর্মীদের কর্মদক্ষতা ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করার চর্চা পুরুষ কর্মীদের তুলনায় অনেক কম। যার ফলে নারীকর্মীরা কোনো প্রতিষ্ঠানের জেন্ডার সংখ্যানুপাত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও গুণগত ভূমিকার দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। পরবর্তীতে যখন পদোন্নতির সুযোগ আসে, নারীকর্মীরা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়।

নিজ কর্মস্থলে নারীকর্মীরা কেমন কর্মপরিবেশে কাজ করে? আসুন, এই বিষয়টির ওপর একটু আলো ফেলি। কর্মস্থলে নারীর প্রতি শারিরীক ও যৌন হয়রানি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। নারীর জন্য সুষ্ঠু ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যৌন হয়রানিকেই কর্মক্ষেত্রে নারীর মূল সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্মজীবী নারী এবং কেয়ার বাংলাদেশ এর ২০২২ সালের একটি স্টাডি অন্য কথা বলছে।

তাদের স্টাডি বলছে, যৌন হয়রানির চেয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীরা মানসিক হয়রানির শিকার হন বেশি। স্টাডির তথ্য অনুসারে ৭১.৩ % নারী কর্মক্ষেত্রে মানসিক হয়রানির শিকার হন। শুরু থেকেই একজন নারী কর্মীকে অদক্ষ, অযোগ্য বলে তাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করা হয়। তাদের মধ্যে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে পুরুষ সহকর্মীরা একজন মেধাবী নারী সহকর্মীকে অযোগ্য প্রমাণ করতে তার বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে। নারীর জন্য কর্মস্থলের পরিবেশ অসহনীয় করে তোলে। মানসিক হয়রানির শিকার হয়ে নারীরা একসময় কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ে, অথবা অবদমিত ও হতোদ্যম হয়ে পুরুষ সহকর্মীর থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। কর্মস্থলে মানসিক হয়রানি ও ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরির মাধ্যমে নারী কর্মীদের মেধার বিকাশ অবদমন করে তাদেরকে অযোগ্য প্রমাণ করার প্রচেষ্টা একটি পুরুষতান্ত্রিক অপকৌশল। নারীকর্মীরা অনবরত এই অপকৌশলের শিকার হয়ে চলেছে।

মানসিক হয়রানি ও অবদমনের বিরুদ্ধে নারীকর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে জোরালো কণ্ঠে কথা বলে না। কারণ, তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কে? সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা, বা কর্পোরেট অফিস, সবখানেই প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্রকাশ্যে বা ছদ্মবেশে ভীষণ রকমের জেন্ডার অসংবেদনশীল। ফলে, ইতোমধ্যেই ভুক্তভোগী নারীকর্মীর আরও বেশি হয়রানির শিকার হওয়ার আশংকা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নারী ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে চাকুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, কেউ আত্মমর্যাদার সঙ্গে আপোষ করে টিকে থাকে। খুব অল্প সংখ্যক নারী এসব অসদাচরণ ও অন্যায্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখায়, লড়াই চালিয়ে যায় এবং কর্মস্থলে অপদস্থ হতে থাকে। আমরা নারীর প্রতি ‘ডমেস্টিক ভায়োলেন্স’ শব্দটির সঙ্গে সুপরিচিতি। কিন্তু ‘ইনস্টিটিউশনাল ভায়োলেন্স’ বা প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতন শব্দটির সঙ্গে ততটা পরিচিত নই। কর্মস্থলে নারীকর্মীরা নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

পুরুষ-অধ্যুষিত বৈষম্যপূর্ণ প্রশাসন ও নারীর প্রতি নেতিবাচক প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ধারাবাহিকতা কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রসরতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি প্রতিষ্ঠানের নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বতন, সকল পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সমতা আনতে হলে নারীকে দক্ষ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তো বটেই, ভয়াবহ রকমের জেন্ডার বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থায় কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নারীকর্মীদেরকে দ্ব্যর্থহীনভাবে পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশনের মধ্যে দিয়ে নিতে হবে।

দেশে সরকারি অবকাঠামোতে একটি দীর্ঘ সময়কাল ধরে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পদে নারী কর্মকর্তা ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন করে উচ্চ থেকে উচ্চতর পদমর্যাদায় নারী কর্মকর্তাদেরকে নিয়ে এসেছেন। সেই নারীরা এসে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তাঁদের ডিসক্রিমিনেশনের কোনো প্রয়োজন ছিল না, তাঁরা এই পদগুলোতে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যোগ্যই ছিলেন।

নারী কর্মকর্তাদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপের প্রতিফলন অন্যান্য সেক্টরগুলোতেও দেখতে চাই। অন্ততপক্ষে ১০ বছরের জন্য প্রশাসন ও ম্যানেজমেন্টের ঊর্ধ্বতন পদগুলোর ৫০ ভাগ নারীর জন্য সংরক্ষিত করা হোক। এই ১০ বছরের মধ্যেই নারীকর্মীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেবে। তারা প্রমাণ করে দেবে যে সংরক্ষিত পদ নয়, তাদের প্রয়োজন ছিল একটি বৈষম্যহীন কর্মপরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্যতার চর্চা।

সিদ্ধান্তগ্রহণের পদগুলোতে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নারী কর্মীরা একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ কর্মপরিবেশ কখনও পাবে না। নারীর উন্নয়ন ও অধিকার বিষয়ক নানা ধরনের পলিসি, কৌশলপত্র লেখা হবে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো কখনও নারীর পক্ষে কাজ করবে না। যতদিন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক অন্যায্যতা ও অপকৌশল চর্চার ধারাবাহিক কাঠামো ভাঙ্গা না হবে, ততদিন পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে নারীরা অসম ও অন্যায্যতার শিকার হতেই থাকবে।

[তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ওয়েবসাইট; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট; মিডিয়া রিপোর্ট]

শেয়ার করুন: