লিপিকা তাপসী:
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নমিনেশন প্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করেছে। কিন্ত মনোনয়নের তালিকায় নারী মনোনয়নপ্রাপ্তদের সংখ্যা খুবই হতাশাজনক। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে বলা আছে, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ৩৩ শতাংশে উন্নীত এবং পর্যায়ক্রমে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
গত নির্বাচনী ইশতেহারেও নারীর সরাসরি নির্বাচনের কথা বলা ছিল। বিএনপির ভিশন ২০৩০ এ সরাসরি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলা না হলেও বলা আছে, ‘সকল কর্মকাণ্ডে নারী সমাজকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করবে, এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সকল বাধা অপসারণ করবে’। কিন্ত বাস্তব ক্ষেত্রে তা যে শুধু কাগুজে প্রতিশ্রুতি তা আবারো প্রমাণিত হলো।

অন্যবারের মতো এবারও নির্বাচনকে সামনে রেখে নারী রাজনৈতিক নেতা এবং নারী উন্নয়ন নিয়ে যারা কাজ করছেন সাধারণ আসনে নারীর মনোনয়ন বৃদ্ধির দাবী জানিয়েছেন। গণমাধ্যমে বড় দুই দলের নীতি নির্ধারকরাও বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, এবারে নারীর মনোনয়ন বৃদ্ধি পাবে এবং গণমাধ্যম এ বিষয়ে রিপোর্টও করেছে এবং সম্পাদকীয় ছেপেছে।
নারীরা তাদের নমিনেশন নিশ্চিত করার জন্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক লবিং এর পাশাপাশি নারীর মনোনয়ন বৃদ্ধিতে প্রথম বারের মতো নারীরা সংঘবদ্ধভাবে বড় দুই দলের নীতি নির্ধারকেদের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে নীতি নির্ধারকরা ইতিবাচক কথাই বলেছিলেন। কিন্ত, ফলাফলে আওয়ামী লীগের ২৩০ আসনের মধ্যে ১৮টি আসনে ১৭জন নারী মনোনয়ন পেয়েছে, বিএনপিতে এপর্যন্ত ৮০০ জনের মধ্যে ৩৭ জন নারী মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকায় আছে, এই সংখ্যা একটু কম বেশি হতে পারে। জাতীয় পার্টি থেকে ৩জন, বাম দল থেকে আরো ২ জন। গত সংসদে সাধারণ আসনে নারী সাংসদ ছিলেন ২৩ জন। যদিও গত নির্বাচনে ১৯টি আসনে ১৮জন নারী মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে আরো পাঁচজন যুক্ত হন। পরিবারের সদস্যরা মারা যাওয়ার পর ঐ আসন শূন্য হলে এই পাচজন সাংসদ হিসেবে যোগ দেন। এই হিসেবে দেখা যাচ্ছে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কমেছে।
এবার ৩০০ আসনে মোট ৪০২৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৪৬জন নারী মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। অর্থাৎ ৩৪৬জন নারী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে অনেকেই আছে দলের দৃষ্টিতে পড়ার জন্যে কিনেছেন কিন্ত মূলত তারা সংরক্ষিত আসনে আগ্রহী। আবার অনেকেই আছেন তারা মাঠে কাজ করেছেন এবং সাধারণ আসনেই তারা নির্বাচন করতে আগ্রহী। সংরক্ষিত আসনের অনেকেই নমিনেশন সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু নমিনেশন প্রদান করেছে তাদের যারা আগের পার্লামেন্টে সাধারণ আসনে সাংসদ ছিলেন। মাত্র দুজন নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে, তাদের দুজনের একজনকে স্বামীর পরিবর্ততে, অন্যজন ব্যবসায়ী।
এবারের নমিনেশনপ্রাপ্তদের দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে দুই এম, মানি এবং মাসল। এক. মাঠ দখলে রাখতে পারবে বা প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে এমন অথবা টাকা আছে যাদের। মানি এবং মাসল নেই কিন্ত মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন এমন অনেক নারী প্রার্থীই পাওয়া যাবে। এমন তরুণও রয়েছেন যারা কাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন কিন্ত তারা নমিনেশন পাননি। টাকার বিচারে এবং মাসল বিচারে নমিনেশন প্রাপ্তিতে নারী এবং সৎ নেতৃবৃন্দ পিছিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এবারে শোনা যাচ্ছিল বিতর্কিত প্রার্থী, জন সম্পৃক্ততা বিছিন্ন নেতা এবার মনোনয়ন পাবেন না। কিন্ত বাস্তবতা হলো অনেকেই বিতর্কিত ব্যক্তিই মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন।
বলা হয়ে থাকে সংরক্ষিত আসন নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে একটি সাময়িক ব্যবস্থা। অর্থাৎ যে নারী সংসদে আসছেন এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা যোগ্যতার বিকাশ ঘটছে। কিন্তু তারা এই দ্ক্ষতা কোথায় ব্যবহার করছে? একবার সরক্ষিত আসনে এমপি হন তাদের অধিকাংশই পরেরবার আর এই সুযোগ পান না কারণ এই ব্যবস্থায় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা কী হবে তার সুনির্দিস্ট মাপকাঠি নেই। ফলে যারা এই ব্যবস্থার ম্যধ্যমে ‘ক্ষমতায়িত’ হবেন তারা আবার ফিরে যান রাজনৈতিক দলের নারী সংগঠনে। যেখানে দলের গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। আর দেশের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ তো দূরের বিষয়। পরের সংসদে যুক্ত হোন আরেক ঝাঁক নতুন মুখ।
ব্যবস্থাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী রাজনীতিবিদদের সাময়িক সন্তুষ্টির বিষয়, দলের অবহেলিত নেতাকর্মীদের পুরস্কারের হাতিয়ার। তবে গত সংসদে নারী আসনে অনেক যোগ্য নারী এসেছে তারা ভাল কাজও করেছে। মাঠে তাদের অবস্থানও তৈরি করেছে। সাধারণ আসনে নমিনেশন চেয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই এবার নমিনেশন পাননি।
নারীর নমিনেশনের বিষয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর দিলে তা টাকা এবং মাসল পাওয়ারের দিকেই ধাবিত হবে। এবারের নমিনেশন তার উদাহরণ। যে নারীরা ঘর-বাহির দুজায়গাতেই প্ররিশ্রম করে, সমাজের চক্ষু রাঙানিকে উপেক্ষা করে তৃণমুলে অবস্থান তৈরি করলো সে নমিনেশন না পেলে অন্য নারীরা আগ্রহী হবে কেন মাঠে কাজ করতে? দলের এতো এতো গবেষণার ফলাফল যখন নেতার রাজনীতিতে না থাকা স্ত্রী পায়, টাকা মাসল পাওয়ার থাকা নেতা পায়, তখন সেটা আর নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয় না।
নারীর তুণমূলে অবস্থান তৈরির থেকে বরং তা রাজনীতিবিদ স্বামী খোঁজার প্রতি উৎসাহিত করে। বর্তমান বৈষম্যমূলক সংরক্ষিত ব্যবস্থা দিয়ে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়, বরং নারীদেরকে আরেকটি বৈষম্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়, বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হয় সে মানুষ হিসেবে নয়, নারী হিসেবে সংরক্ষিত আসনের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে, সে সবার সমান নয়, সে আলাদা কিছু। অনগ্রসর গোষ্ঠীকে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে কোটা প্রথা বিশ্বব্যাপীই আছে, কিন্তু তা হওয়া প্রয়োজন বৈষম্যহীন। সে হওয়া চাই সমান কাজের সুযোগ, সমান বরাদ্দ এবং সমান মর্যাদার।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদে নারী আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৩% করা ও সরাসরি নির্বাচনে নারী আসন বাড়ানো হবে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনসাধারণের জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল পর্যায়ে নারীর পূর্ণ এবং কার্যকর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করাতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অন্তর্ভুক্ত প্রয়োজন। কিন্ত এবারের মনোনয়ন এই সকল লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে না। যেখানে আরপিও এর ধারা দিয়েই দলের প্রত্যেক কমিটিতে নারীর ৩৩% অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি এখনো। তাই সাধারণ আসনে নারীর মনোনয়ন রাজনৈতিক সদিচ্ছায় ফেলে রাখলে তার ফলাফল এর বেশি কিছু হবে না।
যে দেশে রাষ্ট্র নারীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি, ঘরে বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, গৃহস্থালীর দায়িত্ব বন্টন করতে পারেনি, দলের মধ্যে সকল শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি সেকম একটি দেশে আইন দিয়েই সাধারণ আসনে নারী নমিনেশন বৃদ্ধি করতে রাজনৈতিক দলকে বাধ্য করতে হবে। তাহলেই নারী নেতৃবৃন্দ মাঠে কাজ করতে উৎসাহী হবেন। অন্যদিকে নীতিনির্ধারকরাও ইতিবাচকভাবে বিষয়টি দেখবেন।