শীলা চক্রবর্ত্তী:
ভারতীয় সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে ফৌজদারি আইনের আওতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এখন থেকে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আর বেআইনি নয়, কোনো শাস্তি হবে না এরকম সম্পর্কে জড়ালে। স্বভাবতই এ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন মহলে।
গেলো গেলো রব তোলার আগে আসুন দেখে নিই কী ছিলো এই আইনে? ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী কোনো পুরুষ যদি অন্য কোনো পুরুষের স্ত্রীর সাথে, সেই স্বামী নামক পুরুষটির বিনা অনুমতিতে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হোন, তাহলে সেটি হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাঁচ বছরের জেল, সাথে অর্থদণ্ড। আর নারীটির কোনো শাস্তি হবে না। কী ভয়ঙ্কর রিগ্রেসিভ, অপমানজনক একটি আইন!! মেয়েদের “শাস্তি” হবে না!! কিন্তু অপমানটা? স্বামী দেবতার “অনুমতি” থাকলে অপর পুরুষের সাথে সম্পর্কটা কিন্তু বৈধ, অর্থাৎ স্বামীর ইচ্ছে থাকলে তিনি ঠেলেও দিতে পারেন স্ত্রীকে অপর পুরুষের শয্যায়! এখানে স্বামীর ইচ্ছে, তার অনুমতি, স্ত্রীর শরীর বা ইচ্ছের ওপর তার কর্তৃত্বই প্রধান এবং একমাত্র। স্ত্রী অর্থাৎ যার নিজের শরীর , সেই শরীরের বা ইচ্ছের ওপর তার নিজের এককণাও অধিকার থাকবে না। এবং সেটা নিশ্চিত করছে রাষ্ট্র!
যুগে যুগে তো নারীর সাথে এটাই হয়ে এসেছে! মহাকাব্য থেকে শাস্ত্র , ধর্ম থেকে রাষ্ট্র, পরিবার থেকে পুরুষ, সবাই নারীর শরীর-মন-গর্ভ সবকিছুর ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। সেই মহাকাব্যের সময় থেকে বার বার নারীকে কখনও তার অনিচ্ছায় ঠেলে পাঠানো হয়েছে অন্য পুরুষের শয্যায়, বংশরক্ষার তাগিদে, কখনও বা তার চারদিকে কেটে দেয়া হয়েছে পুরুষ অভিভাবকের ইচ্ছের গণ্ডি, কখনও পাঠানো হয়েছে অগ্নিপরীক্ষায়। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছে কেউ জানতে চাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
এইসব নিয়মের প্রচলনকারীরা নিজেদের জন্য রেখেছিলেন বহুবিবাহের সমাজস্বীকৃত ব্যবস্থা, আর নারীর জন্য রেখেছিলেন স্বামীর চিতায় পুড়ে মরার ব্যবস্থা। মৃতের সম্পত্তি নিরঙ্কুশভাবে হাতিয়ে নেয়াসহ অন্য অনেক দুরভিসন্ধির সাথে, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো, নারীর শরীরের ওপর পিতৃতন্ত্রের অধিকারের পক্ষে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া। বিবাহ নামক সামাজিক প্রচলনের আগে নারী ছিল শরীরে মনে স্বাধীন, তার শরীর বা গর্ভের ওপর কোনো একক পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ছিলো না।
কথিত আছে, ঋষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু বিবাহ এবং তদজনিত বিধিনিষেধ প্রচলন করেন, কারণ নিজের মাকে একাধিক পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে দেখে তাঁর সহ্য হয়নি। এখানেও সেই পুত্ররূপী পুরুষেরই আধিপত্যের গল্প। সমাজ বিবর্তনের ধাপে ধাপে নারীর শরীর, বিশেষত গর্ভের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা জরুরি হয়ে পড়েছিলো পিতৃতন্ত্রের জন্য, কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার উন্মেষের সাথে সাথেই এসে পড়েছিলো সম্পত্তির উত্তরাধিকার, রক্তের সম্পর্কের শুদ্ধতার প্রশ্নগুলি। ফলে উত্তরাধিকার এবং রক্তের সম্পর্ক নিশ্চিত করতেই নারীর শরীর এবং গর্ভের ওপর স্বামীর অধিকারের বিষয়টি চেপে বসে। নারী হারায় তার শরীর মন ও গর্ভের ওপর অধিকার। সেইকাল থেকেই চলে আসছে, আজ মহামান্য আদালত, নারীকে তার সেইসব অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। সাথে পুরুষকেও দিলেন এই সংক্রান্ত বিষয়ে অপরাধীর তকমা থেকে মুক্তি।
ব্রিটিশ আমলে করে যাওয়া লর্ড মেকলে প্রণীত দণ্ডবিধির কার্বনকপি হওয়া থেকে ধাপে ধাপে এগিয়েছে ভারতীয় আইনব্যবস্থা , দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক গলানোকে ধাপে ধাপে ছাঁটাই করে। একজন মানুষ তিনি নারী হোন বা পুরুষ, তিনি যার সাথে সম্পর্ক করবেন, তাঁর কোন ধর্ম, কোন জাত, কতো বয়স, কোন লিঙ্গ, কী বৈবাহিক অবস্থা … এসব তো তিনি বা তাঁরা দুজন ঠিক করবেন! একটি সভ্য স্বাধীন দেশে তো তাই-ই হওয়া উচিত! যদি ভালবাসতে গেলেও পদে পদে রাষ্ট্র বা ধর্ম বা পরিবার নাক গলায় , তাহলে কিসের স্বাধীনতা?
আইন থাকে মানুষের কল্যাণের জন্য , শোবার ঘরের বাইরে হেডমাস্টারের মতোন বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রের কাজ নয়। ভালবাসা কোনো অপরাধ নয় , আইনের বেড়া থাকা বা না থাকায় মানুষের সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টাবে না। আদালত সম্পর্কটিকে অপরাধের আওতার বাইরে এনেছেন, বাধ্যতামূলক করে দেননি। যার ইচ্ছে হবে, তিনি সম্পর্কে একনিষ্ঠ থাকবেন, তাঁকে কেউ জোর করে “পরকীয়ায়” বাধ্য করবেন না। ৪৯৭ ধারা বহাল থাকা সত্ত্বেও যে মানুষটি অপর সম্পর্কে জড়িয়েছেন, শাস্তি উঠে যাওয়া মানেই তাকে খোলাখুলি সম্পর্কের ছাড়পত্র দিয়ে দেয়া হলো, এখনও কিন্তু এমনটা নয়। কারণ আদালত বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বুনিয়াদে বিবাহ বিচ্ছেদ আইন বহাল রেখেছেন। অর্থাৎ স্বামীর বা স্ত্রীর, সে সম্পর্ক না পছন্দ হলে, বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার পথ খোলা থাকছে , খোরপোষ সহ। সেখানেও থাকছে খানিক সামলে-সুমলে চলবার প্রচ্ছন্ন নিদান। তবে অদূর ভবিষ্যতে এই আইনটিও পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
মাত্রই কিছুদিন আগে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে অপরাধের আওতার বাইরে এনেছেন। স্বভাবতই এ নিয়েও প্রচুর জলঘোলা হয়েছে। অনেকে বিদ্রুপ করে বলেছেন, এবার ধর্ষণও পেতে চলেছে বৈধতা। সমকামকে পশুকামের সাথেও একাসনে বসানো হয়েছে। এখানেও সেই দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্কের মধ্যে রাষ্ট্রের খবরদারির বিষয়টিই মুখ্য ছিল। ভিক্টোরিয়ান ধ্যানধারণা থেকে, ধর্মীয় নিষেধের বেড়াজাল কেটে বেরোতে অনেক কঠিন লড়াই লড়াইয়ে কাহিনী নিহিত এখানেও। বিদ্রুপকারীরা সবখানেই থাকে, ধর্ষণ এবং সঙ্গমের মধ্যে যে “সম্মতি” বলে একটি বিষয় বিদ্যমান, এ বিষয়ে তারা দৃকপাত করা প্রয়োজন মনে করেননি।
কোনো পরিবর্তনই, কখনোই, মসৃণভাবে হয়নি। এগোতে গেলে যে বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়েই এগোতে হয়, সময়ই তার সাক্ষী। আগামী দিনেও এভাবেই এগোতে হবে। কোনো অধিকারই নাড়ু মোয়ার মতো এমনি এমনি কেউ হাতে তুলে দেবে না।