মারজিয়া প্রভা:
মাতৃত্বকালীন ছুটি কেন মেয়েদের দেওয়া হয়? মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে? অবশ্যই না৷ নারীর অধিকার? অধিকার তো বটেই! কিন্তু যেখানে বহু অধিকারই মানা হয় না, সেখানে সব ধরনের পেশার ক্ষেত্রে কেন মাতৃত্বকালীন ছুটি আছে বলে আপনি মনে করেন? কারণ বাচ্চা পালনের জন্য! বাচ্চা হচ্ছে হিউমান রিসোর্স! সবচেয়ে আরাধ্য রিসোর্স! এই রিসোর্স গড়ে তোলার জন্যই সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইনভেস্ট করে৷ আর সেই ইনভেস্টমেন্টের একটা হচ্ছে মেটারনিটি লিভ! এরকম আরও ইনভেস্ট রাষ্ট্র থেকে করা হয়। যেমন ফ্রি তে টিকা দেওয়া, ফ্রিতে পাঠ্যবই দেওয়া ইত্যাদি!
আমি আগের এক লেখায় বলেছিলাম, মেয়েরা দুই ধরনের রিপ্রোডাক্টিভ কাজ করে। এক তো বাচ্চাকে জন্ম দিয়ে দুধ খাইয়ে বড়সর করে। আর একটা রিপ্রডিউসের মাধ্যমে প্রতিদিন মানুষকে নতুন করে তুলে। প্রতিদিন খাবারটা রান্না করে, কাপড় চোপড় ধোয়, চা টা বানিয়ে দেয়, সর্বোপরি কেয়ার করে। এই যে কেয়ার, এই কেয়ারের কাজগুলো কিন্তু চোখে দেখা যায় না। যদি এই কেয়ারের কাজগুলোই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভংগি থেকে কোনো নারী করতে চায় তাহলে সে অর্থমূল্যের কথা ভাবতে পারবেন না। ২০১২ সালের ওই গবেষণার কথা সবারই মনে আছে! বিলবোর্ডে ছেয়ে গিয়েছিল! নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্য ২৫৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের জিডিপির চাইতে দ্বিগুণ ছিল সেই টাকার পরিমাণ!
Care Economy নিয়ে ফেমিনিস্ট অর্থনীতিবিদদের আন্দোলনটা অনেকদিনের। Economy ব্যাপারটা প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন এবং কনসামপশনের মধ্যেই ঝুলে আছে। আর তাই বিনা বাক্যব্যয়ে নারীর করে আসা গৃহস্থালি কাজ এই Economy তে পাত্তা পায় না। তাই Care Economy টার্মিনোলজির আবির্ভাব ঘটে।
Care Economy নিয়ে আমাদের ক্লাস নিয়েছিলেন নেপালের একটিভিস্ট এবং সাংগাত আ্যালামনাই মোনা শেরপা। যে নারী বাইরে কাজ করছে তাকে কিন্তু ঘরে ফিরে ডাবল বারডেন হিসেবে কেয়ার ওয়ার্ক করতে হচ্ছেই। আবার একজন পুরুষ এই কেয়ার ওয়ার্ক ছাড়া একমুহুর্তে চলতে পারবে না। আমার দেখা বহু পুরুষ এখন একদিনের জন্য বউকে সাহায্য করার ঢং করলেও পুরো কেয়ারের কাজটা এখনো নারীদেরই থাকে।
নারীদের এমপাওয়ারড করার জন্য ঘরের বাইরে কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু কয়টা মিডিয়া আর ডেভলপমেন্ট কাজকর্ম পুরুষকে গৃ্হস্থালি কাজের জন্য পুশ করছে?
সবচেয়ে মজার বিষয়, যেসব পুরুষ নারীর বাইরে কাজ করার ব্যাপারে বিরোধ করে, তারাই অর্থনৈতিক ইনসিকিউরিটি’র সময়ে বউকে বাইরের কাজে পাঠায়। কিন্তু তখনও বউকেই গৃহস্থালি কাজ করতে হয়! ভারতের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গৃহস্থালি কাজে নারীদের অবদান দৈনিক গড়ে ৫-৮ ঘন্টা, অথচ পুরুষদের অবদান মাত্র ২৫ মিনিট! হে হে! একদিন খুন্তি নাড়লেই হয় না ভায়া!
আপনি শুধু ভাবেন, এই এতো এতো কাজ করার পরেও নারীর কাজ কোন “কাজ” হিসেবে স্বীকৃতি পায় না! কোনো পলিসি নাই, রাইট নাই, ল নাই! এই Care ওয়ার্ক সম্পূর্ণ Careless অবস্থায় আছে দেশের কাছে, গোটা বিশ্বের কাছে। সায়েন্স বলে গেছে, কাজ হচ্ছে এনার্জি আর টাইমের গুণফল। W=E*T। এনার্জি যাইতেছে, টাইম যাইতেছে, মাগার কাজকে “কাজ” বলা হচ্ছে না। নারীগণ আজও শুনে আসছে, “বাসায় বইসা করো কী তুমি?”
Care Economy চারটা সলিউশনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। Recognize, Reduce, Redistribute এবং Representation।
Recognize: ও সরকার! ও রাষ্ট্র! ও দেশ! তুমি সবার আগে Recognize করো যে এইটা ‘কাজ’। কারণ রাষ্ট্র যখন পলিসি বানায়, তখন সে দেখে কোথায় কোথায় আমার ঘাটতি! সেইটা পূর্ণ করতে আমার এই এই পলিসি দরকার! অথচ আমি Care Work এর অবস্থাই জানি না! আমি এরে কাজই মনে করি না! আমি কীভাবে এই বিষয়ক পলিসি তৈরি করবো? তাই সবার প্রথম আসবে রিকগনিশন।
Reduce: এরপরেই আসে Time reduce করার কথা। যে ঘরে বাইরে দুই-ই সামলায়, আর যে খালি ঘর সামলায়, দুজনের জন্যই টাইম রিডিউস করতে হবে। এইটা যেমন টেকনোলজি করতে পারে, তেমনি করতে পারে সরকার। মহারাষ্ট্রের খরা এলাকায় প্রতিদিন মেয়েদের সাত-আট কলস পানি আনতে হতো। কোমর ব্যথায় মরে যেত! কত নারী ওখানে কোমর ভেংগে অথর্ব হয়ে আছে অত পানি নিয়ে মাইলের পর মাইল ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে! এখন এনজিও এবং সরকার থেকে ওখানে ট্রলির মতো একটা পানি বয়ে নিয়ে যাবার ডিভাইস তৈরি করা দিয়েছে। ব্যস! এখন ঘরের নারীদের আর বাইরে যেতে দেয় না পুরুষেরা। তারা ইজিলি পানি বইয়ে নিয়ে আসে। কলসের সময় এই পুরুষের সাহায্য কোথাও ছিল না।
Redistribute: Care Work এর সমস্ত কাজ ভাগ করে দিতে হবে পুরুষ সদস্যের মধ্যে এবং কমিউনিটির মধ্যে। পুরুষের মধ্যে তো কীভাবে ভাগ করা যাবে তাতো বোঝাই যাচ্ছে। কমিউনিটির ব্যাপারে একটা উদাহরণ দেই। ভারতের একটা গ্রামে (নাম ভুলে গেছি) প্রতিদিনের দুপুরের রান্না আর রাতের রান্না কমিউনিটির সবাই মিলে করে। কারও ঘরে ইন্ডিভিজুয়াল রান্না হয় না। কাজ ভাগ করে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গ্রামের সবার জন্য রান্না হয়। এভাবেই কেয়ার ওয়ার্ক Redistribute হতে পারে কমিউনিটির মধ্যে।
Representation: কতিপয় উদাহরণ বাদে! বেশিরভাগ মেয়েই তো পরনির্ভরশীল! স্বাবলম্বী হওয়ার কথা ভাবেই না! আরে! সে ভাববে কীভাবে! তার ঘাড়ে আনপেইড এবং কেয়ার ওয়ার্কের যে বোঝা দিছেন, সেই বোঝা নিয়ে সে যাবে কই? তার সময়টা কই নিজেকে স্বাবলম্বী বানানোর!

উপরোক্ত তিনটা সম্পন্ন হলেই আপনি প্রতিটি নারীকে পলিটিক্যালি, সোশ্যালি, ইকোনমিক্যালি Represent করতে পারবেন স্বাবলম্বী হিসেবে। সেও তখন চায়ের কাপে ঝড় তুলে রাজনীতির তর্কে অংশ নিতে পারবে!
নিজের বাড়িতে এই কেয়ার ওয়ার্কগুলো প্রফেশন বেসিসে হতে পারে না কখনো! আবার এই কাজ ছাড়া মানুষ কোন হিউম্যান রিসোর্সে পরিণতই হতে পারবে না। তাই সবার আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই কাজের স্বীকৃতি দরকার! আর তারপর দরকার এই কাজগুলো লাইফ স্কিল হিসেবে নারী-পুরুষ সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে কমিউনিটি বা রাষ্ট্রের ভূমিকাও কম না!
সাংগাতের রান্নাঘরের সামনে থাকা একটা লাইন দিয়ে আজকের বড় লেখা শেষ করছি। ‘We want to forward men to the Family Kitchen!’ আমিন!