ফেমিনিস্ট ট্রেনিং এর ফাঁকে ফাঁকে-১১

মারজিয়া প্রভা:

ফেমিনিস্টদের নিয়ে আটটি কোর মিথ আছে৷ এর আশেপাশে আরও মিথ আছে। প্রতিনিয়ত যেগুলো আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে আরও ঋদ্ধ করে। একটা কাজ করি চলেন, আমি এখানে আটটা মিথ এর লিস্ট দিব। আপনারা আরও কী কী মিথ জানেন, সেগুলো যোগ করবেন। দেখা যাক কত বড় লিস্ট হয়!

মিথ ১- আমরা হচ্ছি পুরুষবিরোধী

উত্তর: ব্যক্তি পুরুষ আর পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম এক না। ফেমিনিস্টরা ব্যক্তি পুরুষের বিরুদ্ধে না। পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে। সোসাইটি যে জেন্ডার তৈরি করে দিয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মিথ ২- আমরা ফেমিনিস্টরা সুখের সংসার ভেংগে ফেলি

উত্তর: খুব একটা ভুল না কিন্তু! আমরা সংসার ভাংগার কথা কিন্তু বলি! কখন বলি? যখন দিনের পর দিন মেয়েটার মুখে কালশিটে দাগ দেখি! মেয়ের মনকে মরে যেতে দেখি! মতামতের বিস্তর প্রভেদ দেখি। মেয়েটা হাঁটুর ব্যথায় হাঁটতে পারছে না, কোমর সোজা করতে পারছে না, কিন্তু মাথায়, ঘিলুতে ঢুকে আছে এক জিনিস, স্বামীর সংসার ছেড়ে কোথায় যাবো? স্বামী তো শরীর দেখে ফেলছে, এখন একে ছেড়ে যাবো কী করে! সেই সময় আমরা বলি, “এবিউজিভ রিলেশন থেকে বাইর হইয়া আসো! চেহারায় কালশিটে হওয়া কোন ভালোবাসা না। স্বাবলম্বী হও, আত্মনির্ভরশীল হও!” এখন যদি বলেন, সুখের সংসার ভাংগি, তো বলতেই পারেন! যদি আপনি ‘সুখ’ বুঝেন বউরে শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতন করা, তবে সে সুখ আমাদের সয় না।

মিথ ৩- ফেমিনিস্ট মানেই মদ খায় আর বিড়ি টানে

উত্তর: হি হি! মুসলিম লোক মদ খায়, আপনারা তখন বলেন না, মুসলিম মাত্রই মদ খায়। কম্যুনিস্ট যখন বিড়ি ফুঁকে, আপনারা কন না কম্যুনিস্ট মাত্রই বিড়ি ফুঁকে। তাইলে কেন নারী বিড়ি ফুঁকলেই তারে ফেমিনিস্ট বানায়ে দেন! আমি অনেক নারী দেখছি, যারা বিড়ি খায়, কিন্তু ফেমিনিস্ট না। আবার যারা ফেমিনিস্ট, তাদের অনেকেই বিড়ি খায় না। এইটা পার্সোনাল চয়েজ। মদ এবং বিড়ি খাওয়া একটা স্টুপিড কাজ। মানুষ স্বাধীনভাবে স্টুপিড কাজ করতে পারবে, সেই অধিকার তার আছে। যেমন পুরুষ করে। তাদের যদি স্টুপিড কাজ করার ফ্রিডম থাকে, মেয়েদের থাকবে না কেন? নাকি ফ্রিডম খালি কিছু মানুষের বগলতলার জিনিস?

মিথ ৪- ফেমিনিস্টদের লম্বা চুল থাকে না, ছোট চুল থাকে

উত্তর: হে হে! আমার জানা মতে, বাস্তবে কোন ‘ফেমিনিস্ট কাট’ নামক হেয়ার কাট নাই। আপনারা ছোট চুলরে আপনারা বয়কাট কন, সেইটা আপনাগো প্রব্লেম! একটা সময় হিন্দু বিধবাদের চুল ছোট করে কেটে রাখা হতো। তারা রাতারাতি ফেমিনিস্ট হয়ে গেছিল বলে মনে পড়ে না। বরং বড় চুলের অনেক ফেমিনিস্ট আপনার আশেপাশেই আছে। তারপরেও কথা, আপনি কারও হেয়ার কাট দেইখা তার আইডোলজি নির্ধারণ করেন কেমনে? এতো বেকুব হলে তো সমস্যা!

মিথ ৫- ফেমিনিস্টরা পুরুষের মতো হতে চায়

উত্তর: খ্যাক! পুরুষ হওয়া যেন গর্বের কিছু! ছ্যাহ! কোনো ফেমিনিস্ট রাস্তায় মুততে চাবে না, কাউরে রেপ করতে চাইবে না, পার্টনাররে পিটাইয়া চান্দে তুলতে চাইবে না! এতো খারাপরা কোনদিন ফেমিনিস্ট হতে পারবে না! পুরুষ হইয়া এতো নিচে নামার সাধ অন্তত ফেমিনিস্টদের নাই!

মিথ ৬- ফেমিনিস্টরা ঝগড়াটে হয়

উত্তর: যুক্তিতে না পেরে তাদেরকে ঝগড়াটে মনে হওয়া স্বাভাবিক। করিমন চাচী কোমর বাঁইধে হরিতন চাচীর সংগে ঝগড়া করলেই তারা দুইজন ফেমিনিস্ট হয়ে যায় না। পুরুষতান্ত্রিক নারীই থাকে। আপনাকে যুক্তি তর্ক এবং ঝগড়ার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।

মিথ ৭- ফেমিনিস্টরা যার তার সংগে শুয়ে বেড়ায়!

উত্তর: শুধু আপনারে পাত্তা দেয় না আর কী! সেক্সুয়াল ফ্রিডম মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে। যদি সেই ফ্রিডম আপনার থাকে, তাইলে একজন নারীরও থাকবে। সে অবশ্যই তার পার্টনার চুজ করার অধিকার রাখে। আর একাধিক পুরুষের সংগে শুইলেই কেউ ফেমিনিস্ট হয়ে যাবে এমন কোনো ম্যানিফেস্টো তৈরি হয়নি। এবং ফেমিনিস্ট হয়ে অনেকে এক পুরুষ দিয়েও জীবন পার করতে পারে। সিমোন দ্য ব্যেভেয়ারকে দেখেন, একজন জাঁ পল সাঁত্রেকে নিয়েই থেকেছে। তবে সে চাইলে অন্য সংগী নিতেও পারতো, সেই অধিকার বা ফ্রিডম তার ছিল। সব ফেমিনিস্ট এই ফ্রিডমে বিশ্বাসী।

মিথ ৮- ফেমিনিস্টরা পরকীয়া করে বেড়ায়

উত্তর: আবারও সেক্সুয়াল ফ্রিডমের কথাই আসে। আপনি বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশন যতদিন রাখবেন, পরকীয়া ততদিন থাকবে। এবং এই বিবাহ ইনস্টিটিউশন প্রাইভেট প্রোপার্টির সময় থেকে শুরু হয়েছে, যখন নারীকে বন্দী করার দরকার পড়ছে। তাই এই প্যাট্রিয়ার্কি ইনস্টিটিউশন থাকলে, সেইটার আড়ালে-আবডালে পরকীয়াও থাকবে। আপনাকে জোর করে সোশ্যাল কন্সট্রাকশান ধরে রাখতে হচ্ছেই। আপনি আর কী করবেন! স্ট্রাকচারের মধ্যে থেকেই মুক্তি নিবেন! এই কথা বলা মানেই পরকীয়া করা না। কারণ আমি পরকীয়া করা এমন অনেককে দেখাতে পারবো, যারা ফেমিনিস্টের ‘ফ’ও বুঝে না। আপনি পরকীয়ার ভিকটিম হলে একে আপনি খারাপ বা জঘন্য বলবেন, আপনি পরকীয়ার গ্রাহক হলে কিন্তু তা আপনার কাছে “প্রেম” বলেই মনে হবে! এর মানে এই না, ফেমিনিস্ট হলেই তাকে পরকীয়া করতে হবে।।

ফেমিনিজম হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণিত আর ডেঞ্জারাস ইজম। সব পাওয়ারফুল পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তিদের এই ইজম ক্রিটিসাইজ করে। তাই ফেমিনিস্ট হলেই আপনাকে গালাগালি শুনতে হবে, এই মিথগুলার সামনে পড়তেই হবে এইটাই স্বাভাবিক! ইহা কোনমতেই সুখের বিছানা নয়!

আজ এক বালতি কাপড় কেচে ঠাণ্ডার মধ্যে হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো করছি। ভাবছি ফেমিনিস্ট এবং কাপড় কাচা সংক্রান্ত কোনো মিথ আছে কিনা!

#Sangat
#23th_Feminist_Capacity_Building_Up_Course
#Day_11

শেয়ার করুন: