সুপ্রীতি ধর:
দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যেসব মেয়ে পরীক্ষা বা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় আসে, তাদের জন্য আবাসন এক ভয়াবহ সংকট। ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা থাকলেও কোন না কোনভাবে হয়তো ব্যবস্থা একটা হয়েই যায় কারও সাথে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি বাড়তি যোগ থাকে বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা আর এগোয় না।
এইতো সেদিনই একটি মেয়ে বলছিল যে, ঢাকার থাকার জায়গা নেই বলে পরীক্ষা দিতে যেতে পারছে না। কোনো বন্ধুর বাসায় থাকতেও সে রাজী নয়। তাছাড়া ছোট মেয়ে আছে তার। মেয়েকেই বা কার কাছে রেখে আসবে! এমনি হাজারও সমস্যার মধ্যেই ছোট্ট একটি খবর।
মাত্র দুদিনের জন্য চাকরি বা পরীক্ষা দিতে আসা মেয়েদের সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা। খবরটি দেখেই এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে। মেয়েদের জন্য কেউ কিছু করা মানেই আমরা যারা নারী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে-ঘাটে কাজ করি, তাদের জন্য নি:সন্দেহে খুবই ভালো একটি খবর। এ ব্যাপারে আরও তথ্য নিতে ফেসবুকে কথা বলি এর উদ্যোক্তা এবং সংস্থাটির চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাসের সাথে। যদিও তিনি নিজের কৃতিত্ব দাবি করেন না। বললেন, “বিদ্যানন্দই হচ্ছে পুরো টিম ওয়ার্ক। একেকজন একেক কাজ করি। আমি চিন্তা করেই খালাস, বাকিটা আমার টিম মেম্বাররা করে ফেলছে”।
এর আগে মাত্র এক টাকায় খাবারের ব্যবস্থা করে বেশ সাড়া ফেলেছিল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। সেই থেকে নিত্য নতুন এবং অভিনব সব উদ্যোগের কারণে সংস্থাটি সবার নজর কাড়ে।
সংস্থাটির ভাষ্যমতে, শিক্ষা এবং চাকরির বড় একটা অংশ এই রাজধানীতে, যেখানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় ঢাকার বাইরের পরীক্ষার্থীরাও। ঢাকায় উঠার মতোন নিকটাত্মীয় কেউ থাকলে তো কথাই নেই, আবার থাকলেও সেখানে উঠা যায় না নানা কারণেই। তখন বন্ধ থাকে ঢাকার দরজা, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। একদিকে নিরাপদ অভিজাত হোটেলগুলো প্রচণ্ড ব্যয়বহুল, অন্যদিকে কম দামি হোটেলগুলোতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। অনেক ছেলে রাতে দীর্ঘপথ যাতায়াত করে পরীক্ষা দিতে আসে, যা মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবার দেয় না, বা সম্ভব হয়ে উঠে না। রাতে বাংলাদেশে মেয়েদের যাতায়াতও তো কম ঝক্কির নয়! নানারকম হয়রানি বা হ্যারেসমেন্টের শিকার হয় মেয়েরা।
এতোসব প্রতিবন্ধকতার কথা মাথায় রেখেই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন মেয়েদের জন্য সীমিত আসনের হোস্টেল চালু করেছে। যেখানে ঢাকার বাইরে থেকে আসা যে কোন মেয়ে ১-২ রাত থাকতে পারবে, এবং সেটা বিনামূল্যে। বিনিময়ে তাঁদেরকে শুধুমাত্র মানব সেবায় এক ঘণ্টা শ্রম দিতে হবে।
শ্রমের ধরনটা কেমন হবে জানতে চাইলে কিশোর বলেন, তাদের এক টাকার আহার বলে যে প্রকল্পটি আছে, হয় সেখানে কাজ করতে হবে, নয়তো বাসন্তী নামের একটি গার্মেন্টস কাজ শুরু করেছে এই মাসেই, সেখানে কাজ করবে। এটা বাধ্যতামূলক।
শ্রমের বিষয়ে কিশোর আরও বলেন, আসলে বিশাল মানবগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজে উৎসাহিত করতেই এই বাধ্যবাধকতা। যাতে তারা ভবিষ্যতেও এমন কাজে উৎসাহী হয়।
এই প্রকল্পটির কথা কেন ভাবলেন?
বর্তমানে পেরুতে বসবাসরত কিশোর কুমার দাস জানান, ইচ্ছা থাকলে স্বল্প সামর্থ্য দিয়েও বড় কিছু করা সম্ভব। পেরুতে তিনি এরকম একটি হোস্টেলের মালিক। সেই ধারণা থেকেই এবং নিজের বড়বোনকে একই দুর্ভোগ পোহাতে দেখে ঢাকায়ও এমন কিছু করার কথা মাথায় আসে। ভবিষ্যতে এটি ৫০ থেকে ১০০ জন মেয়ের থাকার উপযোগী করার ইচ্ছে আছে। তবে এজন্য প্রয়োজন এরকম একটি বাসা। তা দিয়ে যদি কেউ সহায়তা করেন, তবে এটি দ্রুত করে ফেলতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাসের জীবনের একটা সময় অনেক কষ্টে কেটেছে। সেই অনুভব থেকেই তিনি পাঁচ বছর আগে ফাউন্ডেশনটি গড়ে তুলেন এবং এক টাকার আহার নামের একটি প্রকল্প চালু করেন, যার বয়স আড়াই বছর প্রায়। বেশ ভালো কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে। প্রচুর মানুষ এতে সম্পৃক্ত। অধিকাংশই অন্য চাকরি করেন, এবং স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে থাকেন। প্রতিদিন দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই হাজার মানুষের খাবারের সংস্থান করে থাকে সংস্থাটি।
আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য দিলেন কিশোর। গত মাসেই তারা একটি গার্মেন্ট কারখানা কিনেছেন, যেখানে এরই মধ্যে উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। এটাও মেয়েদের জন্য। বাসন্তী নামের এই কারখানাটিতে কাজের প্রধান শর্তই হচ্ছে মেয়েটিকে নবজাতকের মা হতে হবে। পোশাক শ্রমিকেরা যখন মেটারনিটি লিভ পায় না, ছোট বাচ্চাসহ বা বাচ্চার জন্মের কারণে চাকরিচ্যুত হয়, তখন এরকম একটি উদ্যোগ অসম্ভব ভালো লাগায়। তিনি বলেন, মেয়েদের এই করুণ সময়টার কথা মাথায় রেখেই তাদেরকে চাকরি দেয়া হয়। সারাদিনে বাচ্চাদের খাবার এবং মায়েদের দুপুরের খাবার দেয়া হয় কারখানা থেকে। ২৫টা মেশিনে বর্তমানে ৫০ জন কাজ করছে। বাচ্চাদের সাথে রাখার জন্য বাসন্তীতে ডে-কেয়ারের ব্যবস্থাও আছে। যাতে মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন।
এ নিয়ে কিশোর তার টাইমলাইনে কিছু ছবি শেয়ার করে লিখেছেন,
“আমাদের ডে-কেয়ার সার্ভিস-
ক’দিন আগেই মা হয়েছেন সূচনা আপু, এরপর চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে গার্মেন্টসে ড-কেয়ার না থাকায়। ঘরে এতটুকু বাচ্চাকে নিশ্চয় রেখে আসা সম্ভব নয়। আর কয়েক ঘণ্টা পরপর বুকের দুধ বা খাওয়াবেন কীভাবে? এমন সব মায়েদের জন্য আমরা দিয়েছি বাসন্তী নামক গার্মেন্টস, যেখানে নবজাতকের মায়েদের চাকরি দেয়া হয়। আর দেয়া হচ্ছে প্রতিবন্ধী কিংবা পিছিয়ে পড়া নারীদের। জানি লাভের খাতা শূন্য হবে, তবুও পাগলামি আমরা করতে চাই, ভিন্ন কিছু কাজের নমুনা রেখে যেতে চাই”।
মেয়েদের জন্য ঘন্টার চাকরি বলেও একটি প্রকল্প আছে এই ফাউন্ডেশনের। কিশোর জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা অনেক গরীব মেয়ে আছে, যারা হয়তো টিউশনি করতে পারছে না বা পাচ্ছে না, পেলেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় নানা কারণে, তখন তারা টিকে থাকার জন্য হয় রাজনীতির সাথে, নয়তো তাদের জন্য অপমানজনক কোনো পেশায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের কথা বিবেচনায় রেখেই এই ঘন্টায় চাকরির ব্যবস্থা। চার ঘন্টার কাজ করবে বাসন্তীর জন্য বা এক টাকার আহারের জন্য, নগদ টাকা নিয়ে ফিরবে। এছাড়াও সংস্থা থেকে ৪০ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। শর্ত হিসেবে তারাও সপ্তাহে দুইদিন শ্রম দিয়ে যায়। শ্রমটা এখানে বাধ্যতামূলক।

এরকম আরও নানান উদ্যোগ এবং স্বপ্ন নিয়ে কথা হয় কিশোর কুমার দাসের সাথে। মেয়েদের জন্য আরও কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, সেই স্বপ্ন বিনিময়ও হয়। উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে কিশোর কুমার দাস এবং বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে অান্তরিক অভিনন্দন।
মেয়েদের হোস্টেলের জন্য কীভাবে আবেদন করতে হবে?
পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং ফটো আইডির ছবি দিয়ে [email protected] ইমেইলে যোগাযোগ করতে হবে। সেখান থেকে সিট কনফার্ম করে দেয়া হবে ১-২ দিনের জন্য। সংস্থাটিও এও জানিয়েছে যে, কঠিন নিয়মকানুনের মাঝে চলে এই প্রজেক্টটি, সেগুলো মানার মানসিকতা থাকতে হবে।