বেরিয়ে আসে নিজের প্রতিবিম্ব

দিনা ফেরদৌস:

আবেগের বশে আমরা বলে ফেলি অনেক কিছুই, যার পিছনে কাজ করে নিজের রাগ, ক্ষোভ বা অতৃপ্তি। আমরা অপরকে বলতে গিয়ে ছোট, বড় যেভাবেই প্রকাশ করি না কেন; প্রকাশিত হয় মূলত আমাদের প্রতিবিম্বই।

যেমন আমার পরিচিত একজন বন্ধুর কথা বলি, তার নাম ধরি ‘ক’। ‘ক’ এর ধারণা, কেউ ভালো নেই ভিতরে ভিতরে। কথাটা একেবারে মিথ্যা না; কোন মানুষের পক্ষেই প্রতিদিন ভালো থাকা সম্ভব না, তাই বলে প্রতিদিন সবাই খারাপও থাকে না। আমার বন্ধু ‘ক’ এর ধারণা ফেইসবুকে যতো হাসিখুশির ছবি আছে, তার বেশিভাগই নাটক। খুব খারাপ মুড নিয়ে আমি কবে ছবি তুলেছি মনে নেই। আরেকজনের ফেইসবুকের ছবি দেখে ভালোমন্দ যাচাইয়ের প্রসঙ্গ তখনই আসে, যখন নিজের ব্যক্তি জীবনে এইসব ছবি ভাবিয়ে তোলে। বিষয়টা আমার কাছে ঠিক এই রকম যে, যখন কেউ বলে ‘আমি অনেকের চেয়ে ভালো আছি’।

যেখানে একজন মানুষের ভালোমন্দ থাকা নির্ভর করছে তার পরিবার, পরিবেশ, পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে; সেখানে অন্যের সঙ্গে তুলনাটা আসে কীভাবে? তার মানে সে নিজেকে নিজের জায়গায় না ভেবে অন্যের জায়গায় ভাবছে। আরেকটু পরিষ্কার করে বলি।

আমেরিকায় এক বাঙ্গালী গৃহবধুর সাথে একবার কথা হলে জানতে পারলাম, তাকে তার হাজব্যান্ড একা কোথাও যেতে দেন না। তার আইডি কার্ড থেকে শুরু করে যত ধরনের কার্ড আছে, সব তার হাজব্যান্ডের কাছে থাকে। তার কাছে সুখ বা স্বাধীনতা মানে হচ্ছে একা একা কোথাও যেতে পারা। এখন যদি আমি বলি, যাক বাবা, আমি ওই মহিলা থেকে অনেক ভালো আছি, তাহলে কী দাঁড়ালো?
মানে হচ্ছে, আমি নিজেকে ঠিক সেই জায়গা থেকেই দেখছি। যেখানে আমার হ্যাজব্যন্ড কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে চৌদ্দবার আমার সাথে পরামর্শ করেন, সেখানে আমি একজন ঘর থেকে বের না হতে পারা নারীর সাথে নিজেকে তুলনা করছি। তার মানে এই না যে, আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই, আমার অপ্রাপ্তিগুলো শুধুই আমার জন্য আমার মতো করে তৈরি। ওই নারী বাইরে একা বের হবার স্বাধীনতা পেলে যে শান্তি পাবেন, সেখানে আমার পাবার মতো কিছুই নেই। তাই কারও সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।

এবার আমার বন্ধু,’খ’ এর প্রসঙ্গে আসি।
তার একটাই ধারণা, সে সবাইকে একদিন দেখিয়ে দেবে সেই সবার সেরা। এই ধারণা আমি ‘গ’ ‘ঘ’ ‘ঙ’ ‘চ’ ‘ছ’ ‘জ’ ‘ঝ’ সবার মধ্যে দেখে হতাশ হয়ে ভেবেছি, তারা যা করবে তার বিপরীতটাই করবো, আর কিছু পারি বা না পারি। সব জায়গায় নিজেকে সেরা হিসেবে তুলে ধরার কোন মানে হয় না। আর দেখিয়ে দেয়া অত সোজা না।
‘খ’ এর ধারণা ছিল সে সবার চেয়ে আলাদা। কলেজে খেয়াল করলাম বিশেষ করে সব ছেলেদের সাথে সে একটা বিশেষ ভাব নিয়ে চলতো। হাবাগোবা ধরনের ছেলেদের পটানোই ছিল তার কাজ। এরপর তার জন্য কতজন পাগল সেই লিস্ট নিয়ে আনন্দের সীমা নেই। এটা করা তার ঠিক না বা ভালো মেয়েরা এইসব করে না, এই জাতীয় কোনকিছুই আমার কখনও মনে হয়নি।
আরেক বন্ধু ছিল, সে সবসময় বলতো, ছেলেরা সুন্দরী মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করে, ঘুরঘুর করবে ভালো মেয়েদের পিছনে। যে ছেলে পাত্তা দিবে না, সেই ছেলে কারে পাত্তা দিল এই নিয়ে মাথা না ঘামাতে ওই বন্ধুকে বার বার বলেও কোন ফল হয়নি। দুনিয়ার সব সুন্দরীরা ওর চোখের বিষ। সে সুন্দরীদের দোষ বের করতো, ফর্সা হলেও চেহারা ভালো না, চেহারা ভালো হলেও নাকটা বোঁচা, আর কিছু না পেলে চরিত্র নিয়ে কথা বলতো। অথচ আমি যে ‘খ’ এর কথা বলছি, সে দেখতে তেমন ভালো ছিল না, তবে নিজেকে বাংলা সিনেমার নায়িকা মনে করতো।

একজন সাধারণ মানুষের সবার কাছে সমান বিশেষ হওয়ার দরকার আছে বলেও আমার কখনো মনে হয়নি। তাই আঙ্গুর ফল টক বলে, নীতিবাক্য ব্যয় করে ‘খ’ কে আমার কাছে কোনদিনই খারাপ লাগেনি। বরং খারাপ লাগে আজ যখন বিয়ের এতো বছর পরও সে তার বরকে আমাদের কাউকেই দেখায়নি। একদিন দেখানোর কথা বলতেই বললো, কী আর দেখাবো! দেখতে গোল আলু! তার সেই ইমেজ সে আজও বহন করে চলেছে, সে সবার সেরা, তার পাশে সালমান খানের মতো কাউকে আমরা আশা করি। ফলে নিজের বরকে দেখাবার সাহসটুকু আজও তার মধ্যে নেই।

‘গ’ ‘ঘ’ এমন অনেকেই আছেন, যারা বসে থাকেন আজ ভালো খবর দিয়ে সবাইরে জ্বালিয়ে মারবেন। আরে বাবা কাউরে জ্বালানোর আগে জানা দরকার তার আসল জ্বালাটা কোন জায়গায়, তবেই না ঔষধে কাজ হবে। একবার এক বন্ধুর বর ইটালি না স্পেন যাবেন। সেই বন্ধু কোনদিন নিজ থেকে ফোন করেনি, তার বরের তো প্রশ্নই উঠে না। সেই বন্ধু হঠাৎ ফোনে জানালো তার বরের খবর। আমি শুনে অভিনন্দন জানালাম। বিদায় নেবার কথা তার, যিনি বিদেশ যাচ্ছেন, এইসব আচরণ-ই উদ্দেশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। আমার বর যেখানে ছয়মাস পর পর ইউরোপ, আফ্রিকাতে যান নিজের কাজে; সেখানে আমারে জ্বালা ধরাতে হলে আরো বেশি কিছুর দরকার ছিল। অবশ্য আমি আমেরিকা আসার পর সেই বন্ধু বিদেশ নিয়ে আর কিছু শোনানোর সাহস করেনি আর।
আরেকবার ‘ঘ’ মনে মনে বেশ শান্তি পেল আমাকে একটা খবর দিয়ে। বিয়ের পর যখন আমার পড়াশুনা চলছে, তাই বাচ্চা নিয়ে নিজের চিন্তা যতোটা না ছিল সামাজিক চিন্তাটা ছিল তার চেয়ে বেশি। কেউ একজন হঠাৎ বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনিয়ে বলল ‘ মা’ হয়ে গেলাম। অভিনন্দন জানালাম। তখনও আমার মেয়ে হয়নি।

অনেকে বলতে পারেন, খুশিতে প্রিয় লোকে আপনজন’কে জানাতেই পারে। পারে। তবে কথার সুরের মধ্যে ভিতরের না বলা কথা আমরা ঠিকই বুঝি। যেমন একবার ‘ঙ’ বললেন; তোমাদের মতো আমার কাউকে লাগে না, আমি একাই বেশ আছি। কেউ তার নিজের মতো করে বেশ থাকলে, তারে জোর করে মন্দ রাখার সাধ্য কার। তবে সরল সমীকরণ হচ্ছে আমাদের চলতে গেলে কাউকে না কাউকে লাগে। লাগলেই যে সবার পাশে ভরসা করার মতো মানুষ পাওয়া যায়, এমনও কোন কথা নেই; আবার অনেক মানুষ পাশে থাকতেও আমরা একাই থাকি। আবার কারও পাশে ভরসা করার মতো মানুষ থাকলেই তারে পরনির্ভশীল ভাবারও কোন মানে নেই। ‘ঙ’ এর এই কথার মধ্যে আমি তার বেশ থাকাটা দেখতে পাইনি (হতে পারে আমার চোখে সমস্যা)। বেশ থাকলে ঢোল পিটিয়ে বলারও কিচ্ছু নেই। যে বেশ আছে, তার চোখের দিকে তাকালেই যে কেউ বুঝতে পারে। এটা বাংলা সিনেমার কান্না না, যে কেউ দেখে ফেললে বলতে হবে চোখে যেন কী পড়ে গেছে …।

এবার ‘চ’ এর প্রসঙ্গে আসি। তার ধারণা সে একাই কাজ করে জগৎ পাল্টে দিচ্ছে, আর দুনিয়ার বাকি মহিলারা স্বামীর উপর বসে বসে, হিন্দি সিরিয়াল দেখে আর সাজগোজ করে বেড়ায়। নিজের কাজ নিজে করে আরেকজনের উপর এতো ক্ষ্যাপার কী আছে বুঝি না। যেই মহিলারা স্বামীর ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে, তাদের স্বামী ঘাড়ের উপর রেখে খাওয়াবে বলেই নিয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানুন, ওদের বাইরে কাজ করার কোনো যোগ্যতা নেই, আর তাদের স্বামীর অনুমতিও নেই বাইরে কাজের। তাদের মা, বাবারাও ছোট থেকে তৈরি করেছেন শুধু ভালো পাত্রস্থ করার জন্যই। যারা কাজ করেন বাইরে, তাদের কোন না কোন ভাবে প্রস্তুতি আছে, প্রস্তুতি লাগে।

এখানে আমাদের করণীয় আছে অনেক কিছুই। আমরা উৎসাহিত করতে পারি মেয়েদের প্রস্তুতির জন্য, কিন্তু কটাক্ষ করতে পারি না। একটা মেয়ে তার পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার মতো করে ভালো আছে, বলতে পারি না যে স্বামী বাইরে কাজ করতে দিচ্ছে না তো সেই সংসার ত্যাগ করো। একজন যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে না দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো মানে তার সাথে শত্রুতা করাই বটে। কারো প্রতি অন্যায় হলে প্রতিবাদ করতে পারি, কিন্তু কেউ ভালো থাকলে, নিজে ভালো নেই বলে অন্যকে নিজের জায়গায় নামিয়ে আনার কোন যৌক্তিকতা নেই। প্রত্যেকের অবস্থান, পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা জানি না কেউ এমন কিছু কেন মেনে নিচ্ছে; যা অন্যেরা মেনে নিবে না। খবরের পিছনেও অনেক খবর থাকে।

আমাদের দেশে এখনো একটা মেয়ের একা বেঁচে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই,কোন পরিবেশ নেই। কেনো একটা মেয়ে মুক্তভাবে ভাবতে পারছে না, সেটা নিয়ে ভাবার আছে, কাজ করার আছে; কিন্তু দোষারোপ করার কোন অধিকার নেই। আর তুলনা করারও কিছু নেই। আমরা শুধু উন্নত দেশের সাথেই তুলনা করি। তুলনা করার সময় আমাদের দেশের বয়স আর সেইসব উন্নত দেশের বয়স একটু হিসাব করে দেখবেন। আর সঙ্গে ওদের দেশের উন্নতির ইতিহাসটাও জানার চেষ্টা করবেন। আমি তুলনায় বিশ্বাসী না, সেটা মানুষের সাথে মানুষের হোক বা এক দেশের সাথে অন্য দেশের।

অনেকের অনেক কিছু আমাদের ভালো লাগতে নাও পারে। মানুষের ভালমন্দ থাকা, রুচি, ইচ্ছা, আকাংখা এইসব এক দিনে তৈরি হয় না। আর এর বেশিরভাগই নির্ভর করছে তার আর্থিক অবস্থান ও সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। আমার আরেক বন্ধু ‘ছ’, সে সিলেট থেকে ঢাকা প্লেনে যাতায়াত করতো সেই স্কুলবেলা থেকেই। তার বাবা পরিশ্রম করে টাকা কামাই করেছেন সন্তানদের ভালো থাকার জন্য, আমি বড়লোক বন্ধুর প্লেনের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, কখনো মনে হয়নি সে বিলাসিতা করছে।
বড় হতে হতে বুঝেছি, ‘ছ’ এর বাবার আমার বাবার থেকে বুদ্ধি হোক বা যোগ্যতা কোনো একটা বেশি ছিলই। এই পৃথিবীটা যোগ্য লোকেদের জন্য, বুদ্ধিমান লোকেদের জন্য। জায়গা কেউ কাউরে দেয় না, করে নিতে হয়, নিজের ভালো থাকাটা নিজেকেই করে নিতে হয়। নিজের কিছু না থাকার বা করতে না পারার দায় বিশ্ববাসীর ঘাড়ে দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া সম্ভব হলেও শান্তিতে থাকা সম্ভব না।

মানুষের বিভিন্ন ধরনের শখ থাকে, কেউ নিজে সাজতে পছন্দ করে, কেউ ঘর সাজাতে পছন্দ করে, কেউ মানুষ খাওয়াতে পছন্দ করে, টাকা থাকলে কেউ বিদেশে বেড়াতে পছন্দ করে। এই সব কিছুই আপাতদৃষ্টিতে কারো কারো কাছে বিলাসিতা। কিন্তু কথা হচ্ছে সে তার জীবনটাকে উপভোগ করছে তার মতো করে। সব কথার শেষ কথা হচ্ছে; দিন শেষে ভাল থাকা। আবার আমার বন্ধু ‘ক’ এর কাছে ফিরে যাই, যার ধারণা কেউ ভালো নেই, সকলেই নাটক করে। আরে বন্ধু, নাটক এতো সোজা না, যারা টিভিতে, মঞ্চে নাটক করে সবার মনে জায়গা করে নেয়, তারাও সংসার টিকাতে পারে না নাটক করে। বাস্তবে প্রতিদিন নাটক চালিয়ে যাওয়া অতো সোজা না।

আর এতোকিছু বলার উদ্দেশ্য একটাই; আমরা অন্যদের নিয়ে যতো কিছুই বলি না কেনো, বেরিয়ে আসে মূলত আমাদের না বলা কথাই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন নিজের প্রতিবিম্ব।

শেয়ার করুন: