প্রজ্ঞা মৌসুমী:
বিনোদিনীকে কখনো একটা লাল ফ্রক, লাল কামিজ কিংবা লাল উড়নায় দেখেছি কিনা আমাদের মনে পড়ে না। তাই বিয়ের আসরে এমন রক্ত রঙা শাড়িতে জীবন্ত বিনোদিনীকে দেখে আমাদের কেমন এক ঘোর লাগে। কে যেন বলেছিল- সাহসের রং একটাই, একটাই। বিনোদিনী নিজেও কী চমকে যায়নি এতোটা রক্ত রঙা লালে নিজেকে দেখে? সেই কবেকার এক দৃশ্য কাঠঠোকরা পাখির মতো ঠুকরে যায় ওকে। ভীষণ আক্রোশে আলেয়া বুবু ধড়াস করে এক কোপে মুরগী…না, মোরগটা… না, আসিল মোরগ বখতিয়ারের মাথাটা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেছে। ছিটকে পড়ছে, গড়িয়ে পড়ছে কতটা রক্ত।
গোলাম রব্বানীর আদরের মণি মোরগ লড়াইয়ে দক্ষ আটাশ ইঞ্চি বখতিয়ারের হঠাৎ অন্তর্ধান এবং হঠাৎ পাওয়া বিধ্বস্ত দেহ পুরো মহল্লায় তোলপাড় তুলে ফেলে। ‘কে এবং কেন’ এই রহস্যের কূল কিনারা করতে পারেনি কেউই। তখনও জেনেছিল কেবল বিনোদিনী, কিছু কাঁঠালের তলা, সুপারী গাছের আড়ালে দাঁড়ানো দুপুরবেলার আকাশ কীভাবে রাজাকার গোলাম রব্বানীর আদরের মণি বখতিয়ারের শরীরটা কুপিয়ে কুপিয়ে নিভেছিল আলেয়া বুবুর তড়াক করে জ্বলে উঠা একাংশ আগুন।
আলেয়া বুবু মারা গেছে সেও তো হয়ে গেছে অনেক কাল। সময় যেন কত জন্মের কুয়াশা ছড়িয়ে দিয়েছে স্মৃতির উপর। কাঁঠাল গাছের নিচে পড়ে থাকা আলেয়া বুবুর রহস্যময় মৃত্যু কিংবা মৃতদেহও আজ আর তেমন স্পষ্ট মনে পড়ে না। অথচ বিনোদিনীকে দেখে আমরা বুঝি ‘আছি’ শব্দটা কী তুমুল হতে পারে! বাসর ঘরে ফুলের ঘ্রাণ, নিখাদ হাসি কিংবা নতুন বউয়ের ‘চলুন বর্ণমালা লিখি’ পাগলামীকে প্রশ্রয় দিতে মোহাম্মদ আজহারুল ঘ এর পরে ঞ লিখে কিংবা ঞ এর পরে ত বর্গ আর ট বর্গের গড়মিল বাঁধিয়ে ফেলে বিনোদিনীকে যখন এক ঘোর থেকে আরেক ঘোরে ভাসিয়ে নিচ্ছিল, তখনো সে দেখেছিল অজস্র চুমকিরা কীভাবে হয়ে গেছে আলেয়া বুবুর চোখ- আগুন খাওয়া চোখ।
তারও কিছু মাস পর অন্তঃসত্ত্বা বিনোদিনী যখন বোরখা পড়ে আমাদের বাড়িতে এলো, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি,’বিনু, তোর কি খেতে ইচ্ছে করে?’ তখনো আমাদের বিনোদিনী বলে ‘বুবুর বানানো কাঁঠাল বীচির ভর্তা, চালতার আচার, একবার জানো, বুবু কোত্থেকে একটা ডেউয়া নিয়ে এলো! আহ্, মনটা বড্ড চায়…’ কিংবা ধরুন যেদিন আমরা ভয় পেয়ে যাই বিনোদিনী হয়তো আর বাঁচবে না, সেদিন সেই সঙ্গিন মুহুর্তেও বিনোদিনী নাকি দেখেছিল আলেয়া বুবু তার পাশে বসে গাইছে- ‘তোরে বানাইয়া রাই বিনোদিনী।’ আমাদের মনে পড়ে কত দুপুর, রাতে এই গান গাইতো আলেয়া বুবু।
নামেরও যে হিন্দু-মুসলমান আছে বিনোদিনী জেনেছিল শ্বশুরবাড়িতে এসে- ‘হিন্দু নাম রাখছে ক্যান তোমার?’ বুবুর গান শুনেই হয়তো মিনহাজ মুন্সী তাঁর নাতনীর নাম রেখেছিল বিনোদিনী। কে জানে হয়তো আলেয়া বুবু ছিল মিনহাজ মুন্সীরই অনেক কালের গোপন বিনোদিনী, যে বিনোদিনী কোনো এক অভিমান আর অপমানবোধ থেকে একাত্তরের পর কখনও আর মিনহাজ মুন্সীর মুখ দেখেনি। হয়তো ওঁরা মুখোমুখি হতো কেবল এই গানের ভেতর কিংবা আমাদের বিনোদিনীর ভেতর।
আমাদের বিনোদিনী ওর আলেয়া বুবুকে পাশে রেখেই মা হলো। আজহারুল মেয়ের নাম পছন্দ করে সাবাউন বাহার। বিনোদিনী রসিকতা করে- ‘বাহার মানে তো জানি বসন্ত, এই শীতে বসন্ত পেলে কোথায়? শীতের আরবি তো সীতা।’ তারপর বিনোদিনী বরের কাছে আবদার করে ‘এই, মেয়ের নাম বীরাঙ্গনা হলে কেমন হয়?’ আজহারুল বিরক্ত হয়- ‘ভালো লাগে না, ডাকটা যেন কেমন।’ বীরাঙ্গনা নামে খারাপ কী আছে বিনোদিনী ভেবে পায় না। জড়োসড়ো হয়ে থাকা পুতুল মেয়ে ও চায় না। মেয়ে যেন হয় আলেয়া বুবুর মতো- এই চাওয়াই তো ঝিঁঝিঁর ডাকের মতো একঠাঁয়ে ছুঁয়ে গেছে মা-মেয়ের যৌথ নয়ের মাস।
পাদ্রী জোসেফের কথা মনে পড়ে বিনোদিনীর ‘সন্তান কষ্ট করে জন্ম দেয় মা। নাম রাখার অধিকারটা স্ত্রীরই তো বেশি।’ বিনোদিনী তাই আবদার থেকে অধিকারে ফিরে আসে- ‘আমার বীরাঙ্গনাই পছন্দ।’ আজহারুল থামিয়ে দেয়- ‘মেয়ের জন্ম ১৬ই ডিসেম্বরে বলে বীরাঙ্গনা হতে হবে কেন? বীরাঙ্গনা মানে তো ধর্ষিতা নারী।’ ধর্ষিতা! এক কোপে অগণিত মাথা যেন আলাদা করে ফেলে কেউ। কাঠঠোকরা পাখির মতো শব্দ ঠুকরে যায় তাকে- ধর্ষিতা! ধর্ষিতা!
যে বিনোদিনীকে আমরা শেষ কবে কাঁদতে দেখেছি মনে করতে পারি না, সেই বিনোদিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ‘মুখ চিইম্মা বইস্যা থাক্ আর কান্দ, যা আমার চক্ষের সামনে থাইক্কা, যা’। বিনোদিনীর মনে হয় কথাগুলো বলতে বলতে মাটিতে একদলা থুতু ফেলে, দা’টা ক্যাঁচ করে কাঁঠাল গাছে বসিয়ে দিয়ে আলেয়া বুবু চলে যাচ্ছে গাঢ় থেকে গাঢ়তর ঐসব অন্ধকারের দিকে।
আচ্ছা এমনই এক গাঢ় অন্ধকারের মুখোমুখি হয়েই কী সেলিম আল দীন লিখেছিলেন ‘কন্যা, সুখের অংশ নিয়ে চলে যাও তুমি/শোকের পয়ারগুলি থাক জমা বুকে আমাদের!’ পাশের ঘর থেকে কেউ ডাকে ‘ও বৌমা, বাবুরে নিয়া তোমার শ্বশুরের ঘরে আইসো। সবাই মিলে নাম ঠিক করবো।’
বিনোদিনী চোখের জল মুছে, নিজের ভেতর আগুন মাপে, কতকালের জমে থাকা কাঠঠোকরা পাখি তার, বুকে তোলে আরও এক কন্যা- অপরাজিতা। বাইরে তখনো টকটকে অন্ধকার…