আমার পোশাকে আপনার সমস্যা কেন?

মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী:

আমার হিজাবী অনেক বন্ধু আছে, আবার বিকিনি পরে প্রায়ই + “নিপল ফ্রি” আন্দোলনের সাথে জড়িত এমন অনেক বন্ধুও আছে। শাড়ি পরে এমনও আছে, আদিবাসী পোশাক ছাড়া আর কোন পোশাক পরেই না কখনও, এমনও বন্ধু আছে, সব পোশাকেই মহা আনন্দ, এমনও বন্ধু আছে। প্রায় সবারই এমন বন্ধু পরিচিত মানুষজন আছে যারা একটু ধর্ম, জাতের পরিচয়ের বাইরেও মানুষজনের সাথে বন্ধুত্ব করাতে কোনো সমস্যা দেখে না তাদের। বাই দ্যা রাস্তা, এই সব বন্ধুই নারী বন্ধু।

নারীর পোশাক/অলঙ্কার (মানে নারীকে দেখতে কেমন লাগতাসে) তা নিয়া সবার মাথা ব্যথা। কারো মাথাব্যাথা নিজের ভালবাসার মানুষজন নিরাপদ থাকবে কিনা এইসব পোশাক পরলে এই মরার দেশে সে কারণে, আবার কারোর মাথাব্যথা হুদাই। পাহাড়ি মেয়ে কেন পাহাড়ি পোশাক পরে না, বাঙ্গালী মেয়ে কেন শাড়ী পরলো না, আদিবাসী তো কী হইসে, সবসময় আদিবাসী পোশাকই পরতে হবে- তুমরা কি বাংলাদেশের না, তোমরা সাচ্চা দেশপ্রেমিক না, বাঙ্গালী মাইয়া কেন ওড়না দেয় না, হিজাব কেন পরসে- ঐ বেটি জঙ্গি, হিজাব কেন পরে নাই – সে ভাল ভদ্র মেয়ে না, টিপ কেন পরসে- ঐ বেটি খাঁটি মুসলিম না, বড়ো টিপ পরসে – ঐ বেটি নাস্তিক, বিয়া হই গ্যাসে দুই পোলার মা – মাথায় বুকে একখান ওড়না জড়াবে না? স্লিভলেস পইরা ঘুরে কেন শয়তান বেটি, চাকমা পোলা বিয়া করসে পিনন খাদি পরা উচিত, মুসলমান বিয়া করসে ইসলামিক ড্রেস পরিতে হইবে – বাগেরা, বাগেরা, বাগেরা।

পোশাক অনেক কিছু, আবার পোশাক কিছুই না। মানে আপনি যদি সুবিধাজনক অবস্থানের মানুষ হোন – তাইলে এতো ঢং পোশাক নিয়া কেউ করে না। যারা সচেতন এবং সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন – তাঁরা হয়তো অন্য কোন সংস্কৃতিকে অপমান (Cultural inappropriataion, misappropriation) করছেন কিনা তা ভাবেন মাঝে মাঝে। আর যারা সচেতন না, তারা সুবিধাবঞ্চিত অবস্থানের নারীদের পোশাক অলঙ্কার নিয়া লাভজনক ব্যবসা ফাঁদেন। যেমন ধরেন, পাহাড়িদের পয়সার অলঙ্কার, মণিপুরি শাড়ি, পিনন শাড়ী (এইসবের বাইরে থাকে পাহাড়িদের খাবার, সবজি, নিত্য ব্যবহার্য বস্তু) এইসব। পাহাড়ি জীবন আর নারী জীবন খুব সহজ লাভজনক ব্যবসা/পণ্য হয়। হে হে হে।

সুবিধাবঞ্চিত মানুষজনের জন্য পোশাক অনেক কিছু। ইহা হয় একটি স্টেটমেন্ট (বাংলায় কী হবে? জবানবন্দী?)। ইহা হয় আমার রক্ষাকবচ। ইহা হয় আমার পরিচিতি যা আপনি আমলে নিতে চান না। যেমন ধরেন ফ্রান্সে – যে নারী হিজাব নিজ ইচ্ছায় পরেন, উহা হয় একখান স্টেটমেন্ট। কিন্তু আবার ফ্রান্সে (বাংলাদেশে বা যে কোনো দেশে) মুসলমান পোলা (যে কেউ) মুসলমান মাইয়ারে (যে কাউরে) জোর কইরা হিজাব (যে কোনো ড্রেস) পরাইলে ঐটা কোনো স্টেটমেন্ট না, ঐটা একখান নিপীড়ন। ইতর শ্রেণী এইসবের মধ্যে পার্থক্য বুঝে না। সব হয় সাদা, নয় কালা তাঁদের চোখে। মাঝে কোন গ্রে এরিয়া নাই।

সুতরাং কী বোঝা গেলো? একজন নারী (বা পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ) সচেতন ও স্বাধীনভাবে নিজে ঠিক করবে সে কী পোশাক পরবে। তাহা হইবে পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট। সে নিজে ঠিক করবে সে কি পোশাকের মাধ্যমে স্টেটমেন্ট দিতে চায়, না কি চায় না!

এই ঠিক করা যে পোশাক পরছে সে (প্রাপ্তবয়স্ক) ঠিক করবে তাঁর অবস্থান ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে, কোন ধরনের ভয়, হুমকি, প্রেশার ঝুঁকি বা “মানুষে কী বলিবে” তার সম্মুখীন না হয়ে – সে নিজে ঠিক করবে। সে নিজে ঠিক করবে সে কি বেকুবের মতো কনফারেন্স এ বিকিনি পইরা শো অফ করবে, নাকি ছবি তোলার সময় বোরখা দিয়া মুখ ঢাইকা রাখবে। সে নাকে চাইরখান ফুটা করবে নাকি সাড়া গায়ে কুনো ফুটা করবে না, তা সে নিজে ঠিক করবে। আপনি না। সে আপনি যে মরাই হোন। প্রগতিশীল, জঙ্গি, বাপ, মা, বড়ো জন, জাতের ভাই, পাড়ার চাচা, নারীবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, দেশের পিতা যেই হোন না কেন।

দুইখান উদাহরণ দিই- ধরেন আমি এক পাহাড়ি বহু বাংলাদেশীর সাথে বাইরের দেশে এক অনুষ্ঠানে গেসি, যেইখানে আমি আমার দেশকে তুলে ধরার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত। এখন দেশপ্রেমিক সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আপ্নে আমারে কইলেন মাথায় হাত বুলাইয়া- “এই মাইয়া – শাড়ি পরো – লাল সবুজ। দেশটা তোমারও।” আমি আপনারে পাল্টা বলতেই পারি – “জনাব, জনাবা, দেশে তো বাঙ্গালী ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে। দেশটা আমারও। আপ্নে ক্যান আপনার জাত্যাভিমানরে দেশপ্রেম বলে চালাইতে চাইতেসেন? আপনি হোন একখান ইতর।” এখন এই প্রশ্ন আমি তখনই করবো যখন আমি সচেতন এবং আমি দেখতাসি আপ্নে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করাইতেসেন। দেশ প্রেমের অজুহাতে।

আবার ধরেন যখন কোন অনুষ্ঠানে গিয়া কোন নারী আদিবাসী পোশাক পরে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চান, তাও তার নিজের ইচ্ছাতে এবং সচেতনতার জোরে হইতে হবে। আপ্নে আমার জাতের পুরুষ মানুষ, বা মহান নারী বা বয়সে বড়ো দেইখা আপনি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা আমারে বকাবকি কইরা জাতের ড্রেস পরাইতে বাধ্য করতে পারেন না। আমারে বুঝাইয়া বলতে পারেন, কিন্তু এরপরও আমি যদি না বুঝি – গোস্বা করেন। কিন্তু গোস্বা কইরা আমার নামে মানুষের কাছে আমি কতো খারাপ তা প্রমাণে বাজে কথা বলতে পারেন না। বললে আপ্নেও ইতর। আগের জন ব্যবহার করসে দেশপ্রেম আপনি করতাসেন জাতপ্রেম।

নারীর দায়িত্ব আছে, কিন্তু তারে শুধু দায়িত্ব পালন করাবেন অধিকার দিবার সময় লবডঙ্কা, তা তো হবে না বাবুমশায়েরা। আবার যে নারী ভাবে আমি শুধু অধিকার ভোগ করিবো, মানুষ হিসাবে কোন দায়িত্ব পালন করিবো না তাও হবে না – হে নারীকুল। আপনাদের জীবনযাত্রার চিন্তা ভাবনার মধ্যে একটু ব্যালান্স আনেন। বেকুব মার্কা আবেগীয় যুক্তিছাড়া মন চাইলো লিখিলাম/বলিলাম বন্ধ করেন।

শেষ কিছু কথাঃ
১। কোন নারী যখন তাঁর নিজের দক্ষতা, সচেতনতার জোরে, সাহস দেখাইয়া নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া শুরু করে তখন তারে – “বেশ্যা, মাগী, চরিত্রহীন, বহুতজনের সাথে শুইসে, শুইয়া শুইয়া এতো নাম, তোমার অতীত অন্ধকার আমার মুখ খুলো না” বলা মানুষজনের অভাব হয় না। এইসব মানুষজন এইসব পরিচয়ের হইয়া থাকে – আদিবাসী, পাহাড়ি , বাঙ্গালী, প্রগতিশীল, জঙ্গি, নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ, হিজাব পরা, বিকিনি পরা, চেতনাধারি, রাজাকার – শিবির, বামপন্থী ও ডানপন্থী, পরিবারের ও বাইরের।

২। যেসব মানুষজন নারীর পোশাক ও অলংকার (সংস্কৃতি) নিয়া খুব চিন্তিত, তাঁরা একখান কাজ করে দেখতে পারে। তাঁরা নিজেরা যার যার দেশ ও জাতের সংস্কৃতিকে তাঁদের নিজ নিজ পোশাকে অলংকারে নিয়ে আসতে পারে। অথবা নারীদের সংস্কৃতির ধারক বাহক পোশাক পরিধান করে সংস্কৃতি রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। স্যুট কোট পরা কোনো বাংলাদেশী আমারে শাড়ি পরতে বললে আমি যুক্তি দিয়া থাবরামু। শার্ট প্যান্ট টি শার্ট পরা কোনো আদিবাসী পোলা আমারে পাহাড়ি ড্রেস পরতে বললেও আমি যুক্তি দিয়া থাবরামু। দুইটাই আমার কাছে সমান বেকুব, ভণ্ড, নিপীড়নকারী ও ইতর।

৩। আমার (নারীর) পোশাক আমার ঐতিহ্য, আমার পোশাক আমার পরিচিতি। আমার পোশাক আমি কোন পরিবেশের তা প্রকাশ করে। কিন্তু আমি একা না। আমি অনেকে। আমার অনেক পরিস্থিতি ও পরিচিতি, আমি শুধু নারী বইলাই একগোত্রিয় (homogenous) না। আমার পরিচয়ের বৈচিত্র্যতা আছে। আমি একক না – নিচে কিছু উদাহরণ দিলাম।

ক) আমার পোশাক আমার কেন পরা উচিত তা নিয়া যুক্তি দিয়ে আমারে মানুষ ভেবে কথা বলেন, বুঝান। মাইয়া মানুষ বলসি পরতে হইবো এইসব ইতরামি না করে। আমাকে না মেরে আমার চিন্তা জগতে পরিবর্তনে সাহায্য করেন।

খ) আমি কোন পরিস্থিতিতে পইড়া আছি, বড়ো হইসি তা ভাবেন। আমার পোশাকের কারণে আমার ছবি ভিডিওতে দেইখা লেবেলিং করা বন্ধ করেন। আমি হয়তো এই পোশাক পরতে বাধ্য হইসি। বাধ্য করার পরিবেশ কেমনে ঠেকানো যায় তা ভাবেন।

গ) আমারে কেউ জোর করে নাই। আমার ভালো লাগে হিজাব পরতে, আমার ভালো লাগে বিকিনি পরতে, আমি আমার কাজের ব্যস্ততা অনুযায়ী কখনো পিনন, কখনো জিন্স, কখনও শাড়ি পরি। আমার ইচ্ছা।

শেয়ার করুন: