রাজিয়া রহমান জলি:
৩১শে অক্টোবর ২০১৫ তারিখটা দীপনকে কেড়ে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে আবদ্ধ করে ফেলেছে এক অদৃশ্য মায়াজালে। যদিও আমরা কেউ কাউকে চিনি না, ৭ জুন ২০১৮ এর আগে আমাদের দেখাও হয়নি কোনদিন।
অসলো থেকে সিয়েন শহরে যেতে দুঘন্টা সময় লাগে, যাত্রা পথের অপার সৌন্দর্য হৃদয়ে লেখা যায়, কলমে কুলায় না। সকাল দশটার আলো ঝলমল দিনে সিয়েনের বাস স্টপেজে যিনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি রুনা ভাবী, শামীম রুনা। আমি তাঁকে আলিঙ্গনের মুহূর্তে আমার ভেতর তোলপাড় শুনেছি…চাপাতি আমার ওপর বৈধব্য চাপিয়েছে ৩১শে অক্টোবর, যা থেকে দৈবাৎ নিস্তার পেয়েছেন রুনা। সেই চাপাতির দাগ চিরস্হায়ী হয়েছে আহমেদুর রশীদ টুটুল ভাইয়ের মুখশ্রীতে, দুই মেয়েকে সাথে করে এনারা আশ্রয় নিয়েছেন শান্তির দেশ নরওয়েতে…আর আমরা তিনজনই ৩১শে অক্টোবরের কাছে জিম্মি হয়েছি।
ওদের বাড়ি দারুণ সুন্দর, কবিতার মতো সাজানো সবকিছু…যে কবিতাতে সমস্ত আলো আঁধারের জড়াজড়ি। রুনা পরিশ্রমী, সংসারী… সারা বাড়িতে তার যত্নের ছোঁয়া, আবার দেশের জন্য অশ্রু ঢালা সুরও বাজে কোণায় কোণায়।
যতবারই রুনা আবেগতাড়িত হোন আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে…আমি ততবারই প্রবোধ জানাই তাকে…inspire করার চেষ্টা করি ভালো ভালো কথা বলে। জানালায় রাখা ছোট্ট কমলার গাছ মনে করিয়ে দেয় টুটুল ভাই সিলেটি… আমার দেশী ভাই।
আমি বেশ কিছুক্ষণ সে বাড়িতে সময় কাটানোর পর টুটুল ভাই কাজ থেকে ফিরলেন। আমাদের দেখা হলো… আমাদের কথা হলো অনেক… আমরা দুজন দুজনের চোখে চোখ রেখে অব্যক্ত বেদনায় নীল হলাম এবং সুকৌশলে আমাদের কষ্ট চাপা দিলাম হৈ চৈ কোলাহলে ঘুরে বেড়িয়ে। আমাদের সঙ্গ দিলেন লিসা-এ্যাড দম্পতি…. অনেকদিন বাংলাদেশে থেকেছেন বলে এঁরা বাংলায় কথা বললেন আমার সাথে।
আমরা হেনরিক ইবসেনের শহরটায় আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে বেঁচে থাকার গল্প বিলি করলাম। মাত্র একটা দিন ওদের সাথে কাটিয়ে আমি পরম বন্ধুত্ব অনুভব করেছি। যত্ন করে আমার জন্য রান্না করা, ব্যাগ গুছিয়ে দেয়া, টিকেট কিনে দেয়া, স্টেশনে পৌঁছে দেয়া… সব করেও ওরা দুজন যেন তৃপ্ত হোন না।
অনেক সংকটের গল্প শুনিয়েছেন ওরা আমাকে। অনেক বিষন্নতা,অনেক যুদ্ধ… বিদায়বেলাতে রুনা ভাবীকে জড়িয়ে শুধু বললাম, দুজন একসাথে থাকলে সব যুদ্ধ জয় করা যায়। প্লাটফর্মে নেমে দাঁড়িয়ে দুজন যখন চলন্ত ট্রেনে বসে থাকা আমার দিকে হাত নাড়ছিলেন… আমি তখন মন থেকে আশীর্বাদ করলাম। আগামী দিনগুলি টুটুল-রুনার জন্য সর্বোচ্চ সুন্দর হোক।
আমাদের আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।