দুই বাংলার কি কখনও এক হওয়া সম্ভব?

সুষুপ্ত পাঠক:

দুই জার্মানি এক হয়ে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দুই কোরিয়াও একদিন এক হয়ে যাবে। কিন্তু বিভক্ত বাংলা কি কোনদিন এক হবে? তার আগে জানা দরকার কেন বাংলা ভাগ হয়েছিলো…।

পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা তিরিশ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেছে। আর বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের মাথায় টুপি দিয়ে, হজ করে নিজেকে ধর্ম বিশ্বাসী মুসলমান সাজতে হয়। বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বইতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস বলতে গিয়ে দেখিয়েছেন, দেশভাগে রেল বিভাগের শ্রমিকদের যাদের বেশির ভাগ হিন্দু ছিলো, দেশ ত্যাগ করে চলে যাবার পর কমিউনিস্ট আন্দোলন এখানে প্রবলভাবে ধস নামে। ভারত থেকে আসা মুসলমান শ্রমিকদের কমিউনিস্ট পার্টি করার হার ছিলো খুবই সামান্য। কমিউনিস্টরা আল্লা খোদা মানে না- এসব কারণে কমিউনিস্টদের শক্তি পূর্ববঙ্গে তথা পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বল হয়ে পড়ে।

এখান থেকে দুই সম্প্রদায়ের একটা মানসিক দিক বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। কিন্তু আমাদের দেশে এরকম ইতিহাস পড়ানো হয় যে, আমরা মুসলমানরা ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা হারানোর পর অভিমান করে ইংরেজি শিক্ষায় অনিহা করেছি আর এই সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা ইংরেজি শিখে তাদের কাছাকাছি যেয়ে নিজেদের উন্নতি করেছে। এই বানানো ইতিহাসের কোনো ভিত্তি নেই। সামন্ত যুগে যখন মুসলিম শাসন চলছে, তখন রাজ দরবারের ভাষা ছিলো আরবী-ফারসি। এই ভাষাতেও শিক্ষিত মুসলমান পাওয়া তখনো ছিলো খুব কঠিন।

দেখা গেছে হিন্দুরা আরবী-ফারসি শিখে রাজদরবারে চাকরি করতো। এর কারণ মুসলমান সমাজে শিক্ষায় অনিহা। নবাব-বাদশাহর যুগেও তাই স্থানীয় মুসলমান পিছিয়ে ছিলো। এই দোষ তাহলে কার? ইংরেজি আমলেও একই চিত্র। এমনকি যে পাকিস্তান মুসলমানদের ভাগ্য বদলে দেবার জন্য কায়েম হলো, সেই পাকিস্তান আমলেও দেখা গেলো শিক্ষায় মুসলমানদের আগ্রহ কম। ৬৫ সালের রায়টের পর স্কুলগুলো খোলার পর যে চিত্র দেখা গেলো, কয়েকজন মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া পুরো ক্লাশ ফাঁকা। শিক্ষকদের প্রায় কেউ নেই। কারণ তখনো শতকরা সত্তরজন স্কুল স্টুডেন্টই ছিলো হিন্দু। শিক্ষকদের সকলেই প্রায় হিন্দু।

ক্ষমতার বিষয়ে যদি বলি, ১৯৩৭ সালে যখন দেশভাগ হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, সেই সময়ে ঢাকা থেকে খাজা বংশের এগারোজনই এমএলএ হয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হোন এবং তার ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন হোন শিল্পমন্ত্রী। তবু কেন হিন্দুদের না খেদালে মুসলমানের ভাগ্যের উন্নতি হবে না?

পাকিস্তান আন্দোলনে শ্লোগান ছিলো ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’। এই শ্লোগান দিয়ে দেশভাগের পর, পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের দেশ ত্যাগের পর, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সব সময়ই হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের ভয়ে তটস্থ থাকত। এখনকার রাজনীতিবিদদের, হোক তিনি অবাঙালী বা দেশ স্বাধীন হবার পর স্বদেশী কেউ, তারা প্রত্যেকেই ভারতের ষড়যন্ত্র, ভারতের এজেন্টদের দেশ ছেয়ে ফেলার গুজব জনগণকে খাইয়ে ক্ষমতায় বসেছে। আর বিপক্ষকে ভারতের সেবাদাস, দালাল বলে কোণঠাসা করেছে। কারণ জনগণ হিন্দুদের ঘৃণা করে। তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে জানে হিন্দুরা তাদের শত্রু, তাদের ভালো চায় না, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত আছে। রাজনীতিবিদদের পর সাহিত্যিকদের এইখানে বড় একটা ভূমিকা আছে জনগণকে বিরূপ করে তোলার বিষয়ে।

বাংলা ভাগ হয়েছে এর অন্যতম কারণ এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। দেশভাগের পিছনে রাজনীতিবিদদের কার কী ভূমিকা ছিলো কম বেশি আমরা তা জানি। কিন্তু পূর্ববঙ্গে সাধারণ মানুষ ছিলো মুসলমানদের জন্য পৃথক দেশের পক্ষে। পাকিস্তান বানিয়েছে বাঙালী মুসলমান। পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই ভাগে পরিচিত বাংলা অবিভক্ত থাকলে ঢাকা বা এখনকার বাংলাদেশের উন্নতি হতো না এটা হাস্যকর যুক্তি। কারণটা ঐ স্কুলের ক্লাশ রুমের ভেতরেই আছে। দেশভাগ সত্তরজন হিন্দু স্টুডেন্টকে খেদিয়ে ২০ ভাগ মুসলমান স্টুডেন্টের মধ্যে সমস্ত রাজনীতি অর্থনীতি ভাগ করে দিয়েছে। যে বিশজন স্টুডেন্ট ঢাকা শহরকে গড়ে তুলেছে, অবিভক্ত বাংলায় কি সেই আশিজন বিতাড়িত স্টুডেন্ট ভূমিকা রাখতো না? জ্যোতি বসু দেশভাগে দেশ ত্যাগ না করলে কি এদেশে রাজনীতিতে তার মেধা কাজ করতো না? আমার এই সমীকরণ কি আপনি মানতে পারছেন না? তাহলে কে সাম্প্রদায়িক?

‘বাংলাদেশ একটি মুসলিম কান্ট্রি’ এই আকাঙ্খা কি সব মুসলমানের ভেতরেই রয়ে গেছে? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই, অবিভক্ত বাংলায় বাঙালী হিন্দু আর খ্রিস্টান এই দুই সম্প্রদায়ই প্রধান ছিলো, তাহলে কি দেশভাগ হতো? আমরা কি জানি না, মুসলমানদের ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ তাদের নিজ জাতি ও স্বদেশে পরবাসী করে রাখে? তাই দুই জার্মানি ও দুই কোরিয়া এক হতে পারলেও বাংলা হতে পারে না। এখন তার প্রয়োজনই নেই হয়তো।

তবে ইতিহাস তো একটা জাতির জন্য, সম্প্রদায়ের জন্য আত্মসমালোচনার জন্য রয়ে যায়। ১৯৪৭ আমাদের সেই আত্মসমালোচনার ইতিহাস। আফসোস, আমরা তাকে বাদ দিয়েই আমাদের ইতিহাস শুরু করি…।

শেয়ার করুন: