শেখ তাসলিমা মুন:
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এক্টিভিস্টস, জার্নালিস্টস, ব্লগারস, প্রকাশক দেশ ত্যাগ করেছেন বিগত বছরগুলোতে। তার কারণ কম বেশি আমরা জানি।
এ গ্রুপের ভেতর সবচাইতে বিতর্কিত গ্রুপ নাস্তিক। নারীবাদী এবং নাস্তিক লেখক হিসেবে দুযুগের বেশি সময় আগে তসলিমা নাসরিনকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি একা ছিলেন।
এ যাত্রায় একটি বড় সংখ্যক ‘এরা’ দেশ ত্যাগ করেছেন। প্রশ্ন থাকতেই পারে, এদের ভেতর ‘ফেইক’ এক্টিভিস্টস আছে কিনা। বা দেশে সবার জীবন বিপন্ন ছিল কিনা! অনেকে এ সুযোগটি ‘ব্যক্তি উন্নয়ন’ খাতে ব্যবহার করেছেন কিনা! কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞাবিহীন মদ খেতে এসেছেন কিনা! কেউ কেবল নারী নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছেন কিনা! মোদ্দা কথা, নিজের ফ্রিডম এনজয় করতেই এ সুযোগ নিয়েছেন।
এমন কথা সিরিয়া ইরাকের রিফিউজিদের বিষয়েও বলা হয়ে থাকে। তাঁদের দেশে যুদ্ধ লাগলেও সবাই ‘যুদ্ধ বিপন্ন’ ছিল না।
আচ্ছা কেউ কি জানেন, নরওয়েতে ইমিগ্র্যান্ট প্পুলেশনের প্রধান অংশ পাকিস্তানি জনগণ কিভাবে হয়? জানেন কি, পাকিস্তানিরা যখন আমাদের ভূখণ্ডে হত্যার তাণ্ডবলীলা শুরু করেছে, তখন ঐ পাকিস্তানেরই একটি বিশাল অংশ নরওয়েতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিল। বক্তব্য কি ছিল জানেন? ‘ইস্ট পাকিস্তানের’ মানুষ তাদের হত্যা করতেছে। তখন জিওগ্রাফি বিষয়ে ধারণা এই বলদদের ছিল না। দলে দলে হাজারে হাজার পাকিস্তানি নরওয়েতে এসাইলাম পেয়েছিল। তারাই আজ ডিম পেড়ে বাচ্চাকাচ্চা বাড়িয়ে বিশাল জনগোষ্ঠী। তারা নরওয়েতে ইন্টিগ্রেশন নিয়ে যুদ্ধ করে। নরঅজিয়ানদের পাকিস্তানি কালচার শেখায়।
বলছিলাম যুদ্ধ ফিল্ডের কথা। একটি দেশে যখন যুদ্ধ চলে সে যুদ্ধ কেবল সে জিওগ্রাফিতে চলে না। সে যুদ্ধের ভয়াবহতা পৌঁছে যায় মানুষের ভেতরে, অভ্যন্তরে। তার অস্তিত্ব ধূলিসাৎ করে দেয়। তার সকল নিরাপত্তা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তার ফান্ডামেন্টাল নিরাপত্তা কেড়ে নেয়। যে ভীতি তাঁর মনের গভীরে পৌঁছে যায় তা কেন পৌঁছুলো তা নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা বাঁধা নিষেধ জারি করা যায় না। সে প্রশ্ন তাকে করার কিছু নেই। যুদ্ধটা কারা এবং কেন বাঁধলো, সে প্রশ্নটি বরং অধিক প্রাসঙ্গিক।
অনেক লেখক কবি বা এক্টিভিস্ট আগুনে বসে আন্দোলন করেন। অনেক কবি আগুনে বসে কবিতা লিখে গেছেন। পৃথিবীতে কোনো কোনো কবিকে তো জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
তারা ফিল্ড ত্যাগ করেননি। সেজন্য আদর্শের সেটাই কেবল একমাত্র মানদণ্ড সেটা আমরা বলতে পারি না। সেটাই কেবল আদর্শ মাপার মাপ ও যন্ত্র সে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। এবং সে সিদ্ধান্ত দেবার আমরা কেউ নই। তবে কেউ কেউ সেটি মনে করলে কারও কিছু করার বা বলারও কিছু নেই। আমাদের পৃথিবীতে আমরা সবাই ফ্রি। কেউ কাউকে কিছু বলা থেকে বিরত থাকতে পারে না।
তবে ধরে নেই যদি কেউ কেউ কেবল তাঁদের দারিদ্র মোচনে আগ্রহী হয়েই দেশ ত্যাগ করেন, তাঁদের সে ফিল্ডের যুদ্ধ কম কিছু, তা বলি কী করে? একটি দেশে যখন রাস্তায় নেমে একজন সাংবাদিককে পা হারিয়ে বসে থাকতে হয় বাসের নিচে, তাঁর জীবনটি বাঁচানোর তাঁর যুদ্ধকে আমি ছোট করে দেখতে পারি না।
একটি দেশে নিরন্তর অবিচারের রাজত্বে জীবন এবং যাপনের যুদ্ধটিও থেমে যাবার মুখে, তার বেঁচে থাকা যখন হুমকির মুখে নিয়ত সেখানে যে কেউ দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং সেজন্য তারা কম দেশপ্রেমিক, সেটি আমি কিছুতেই মনে করি না। আন্তর্জালিক পৃথিবীতে মানুষ কোথায় বসে কাজ করছে সেটি আজ খুব বড় প্রশ্ন নেই। আমার মতো ছাপোষা কর্মচারিও বাসায় তিনদিন অফিস করি। অফিসে গিয়ে বসতে হয় না। কী কাজ করছি সেগুলো কম্প্যুটারে জমা হয়ে যাচ্ছে।
মানুষের দরকার ইন্টারনাল ফ্রিডম। মানুষের দরকার ফিজিক্যাল ফ্রিডম, নিরাপত্তা। সৃজনশীলতা একজনের জন্য যা. তা অন্যজনের জন্য নয়। প্রত্যেকের পথ ও পদ্ধতি ভিন্ন। তার চয়েস ভিন্ন।
যে দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই। কথা বলার নিরাপত্তা নেই, ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে ফেরার গ্যারান্টি নেই সে দেশে কেউ তার জীবন বাঁচাতে চাইলে আমি অন্যায় দেখি না। এ জীবন বাঁচানো দরকারি বরং তার আরও কিছু দেওয়ার আছে কিনা ছিল কিনা সেটা পরখ করার জন্যই।
এগেইন, আমরা সবকিছু ফর্ম করতে চাই। একটি শেইপ থেকে বেরুতে দিতে চাই না। আমরা আদর্শায়িত করি, আইডিয়ালাইজড করি একটি ডায়াসকে সামনে রেখে। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। তাকে তাঁর জীবনের সিদ্ধান্তটি তাঁর মত করে নিতে হয়। এটি নিয়ে টিকা টিপ্পনির কিছু নেই। সে যা তাকে সেটা হিসেবে দেখাই মঙ্গলজনক। তার বেশিও নয়, কমও নয়।