বেহায়া জাতি! চলেন লজ্জা পাই!

পৃথা শারদী:

ফেসবুকে একটা ছবি বারবার চোখের সামনে আসছে, কোনো ছবি কিংবা নিউজ ভাইরাল হবার এ এক বড় দোষ, না চাইতেও কিছু ব্যাপার সামনে আসে; ক্রিকেট খেলার হার-জিত, রাস্তাভর্তি নর্দমা, ট্রাফিক জ্যাম, কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর হাজার হাজার ওয়েডিংএর ছবি-ভিডিও এসব ভাইরাল হয়ে সামনে এলে চোখে তেমন লাগে না; মাথায় চাপও ফেলে না, অপ্রতিরোধ্য গতিতে যে দেশ ছুটে চলছে, এসব তারই নমুনা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই, ভাবি সব যে ভালো হবে, তাতো না!

এসব হচ্ছে দেশের মন্দের ভালো; তবে সকাল থেকে যে ছবিটা ভাইরাল হয়েছে, সে ছবিটা আমাকে স্থির থাকতেই দিচ্ছে না; আপনারা সবাই নিশ্চয়ই দেখেছেন? শেয়ারও দিয়েছেন, লজ্জা, ধিক্কার, ছিঃ এমন নানা ক্যাপশন দিয়ে। কালকের মাঝেই ছবিটা চাপা পড়বে সকালের সেলফিতে, চিনতে পারছেন না ছবিটাকে? ভুলে যাবেন জানতাম, আমিও ভুলে যাবো, ভুলে যাবার আগে স্বাধীনতা দিবসে একসাথে লজ্জা দিতে ও পেতে কিছু কথা শোনাতে আসলাম।

বেশ অনেক আগে জাহাংগীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, ধর্ষণের পর তার হাত ও পায়ের রগ কেটে ফেলে রাখা হয়, টিভিতে দেখেছিলাম মেয়েটার হাত-পা ফুলে আছে, কতকটা সেলাই দেয়া, হাসপাতালে ভর্তিও ছিলো, শেষমেষ মরে গেলো; ধর্ষণ কী, সে বোধ আমার হয়নি তখনো, তবে বুঝেছিলাম ধর্ষণ ভালো কিছু নয়।

তনু নামের এক মেয়ে, চেনেন মনে হয় আপনারা! অই যে হিজাব পরতো, এই তো কিছুদিন আগেই তার মৃত্যুবার্ষিকী গেল; তাকেও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ধর্ষণ করে মাথাটা ইটে থেঁতলে খুন করা হয়েছে; পরবর্তিতে এখন মনে হচ্ছে এমন নিশ্চয়ই হতেই পারে, না? হওয়াটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক না?

শ্রীপুরে একজন শিশুকে আয়েশা নাম্নী এক শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, পুনরায় শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়, শিশুটির পিতা ধর্ষণের বিচার চেয়েও বিচার পাননি, ক্ষোভ লজ্জায় ক্রোধে বিমর্ষ পিতা শিশুটিকে নিয়ে ট্রেনের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, বাঁচতে যে পারেননি তা আর বলে আপনাদের অপ্রস্তুত করবো না।

এসব তো আজকালের কথা; গরীব দুখী’দের নিয়ে বলেই চলেছি, অনেকেই বলছেন, গরীবের আবার ইজ্জত!

শাজনীনকে চেনেন? ধনীর দুলালী ছিলেন তিনি; আমি পেপার পড়ার সময় থেকে দেখেছি ২৮ এপ্রিলে একজন মেয়ের ছবি প্রথম পাতায় আসে, এই মেয়েটিকেও ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল তার বুকের ওপর বসে; কী বিপদ বলেন তো! ভয় লাগে নাকি একটু একটু? মনে হচ্ছে নাকি যে নিরাপদে না আপনিও?

আচ্ছা, ভয় দেখাবো না, বাচ্চাদের নিয়ে আরো কিছু বলি?

এক চার বছরের শিশুকে এর মাঝে ধর্ষণ করা হয়, কন্যাকে একখানা চকলেটের লোভ দেখানো হয়েছিল, চার বছরের শিশুর যোনি পথের প্রশস্ততার ওপর রাগ করে আ দয়েই ধর্ষণ করা হয়,বাচ্চাটাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসার পর যখন ক্ষতবিক্ষত যোনিপথ সেলাই করা হচ্ছিল তখন শিশুটি কাটা মাছের মতো ছটফট করে বলছিল, “আর খেলতে যাবো না, আর দুষ্টামি করবো না” এমনি আরেকখানি ধর্ষণের খবর আমাদের মনে আছে তো? যেখানে এমনি এক ছোট্ট শিশুকে ধর্ষণ করে গলা টিপে মেরে তার মুখ কমোডে উলটো করে ফেলে দেয়া হয়েছিল?

রূপাকেও চিনবেন মনে হয়, রাতের বেলা বাসের ভেতর যার ঘাড়খানা মটকে দেওয়া হয়েছিল? ধর্ষণের পরে? পাখির ঘাড় মটকানোর মতো করে? রুপকথায় যেমন করে ঘাড় মটকানো হতো, ঠিক তেমন করে!

যাক এসব কথা, যে ছবি নিয়ে এতো কথা, সে ছবিতে ফিরে আসি।

হবিগঞ্জে ব্রাহ্মণডোর নামের এক গ্রামে এক সবুজ ধানক্ষেতের পাশে একজন মেয়ে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে আছে, পরনের জামা গোলাপি লাল, ভেজা কাপড়ে উরু স্পষ্ট হয়ে আছে, তার বিছানা সবুজ ঘাস; চারপাশে বেশ লোক জমেছে, একজন পুলিশও আছেন দেখছি! কী ব্যাপার আসলে!
ব্যাপার কিছুই নয়! ২৬শে মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে বিউটি নামের এই ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে।
ঠিক ধরেছেন, আমরা কিছুই করতে পারিনি, ছবি শেয়ার দেয়া ছাড়া। মাস দুয়েক আগেও মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এবার আবারও করা হলো এবং এবার তাকে মেরেই ফেলা হলো। হ্যাঁ অবশ্যই, মেয়েটির পরিবার সাহায্য চেয়েছিলো, মামলা করেছিল এবং অবশ্যই কোনো কাজ হয়নি এতোসব করেও।

এসব ধর্ষণের কমন ব্যাপার হোলো এরা শিশু থেকে বৃদ্ধা, সকলেই নারী, সকলেরই যোনি আছে, উন্নত-অবনত-অনুন্নত স্তন আছে! এদের দেখে পুরুষের অপদমিত কাম জাগে, ভালোবাসার ইচ্ছা জাগে।

আচ্ছা কাম তো জাগতেই পারে, তাই না?

এমনটা হতেই পারে, না?

২০১০ সাল থেকে ধর্ষণের পরিসংখ্যান তুলে ধরছি:

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিন হাজার ৯২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৩ সালে ২ হাজার ৯২১ এবং ২০১৪ সালে ২ হাজার ৯১৮টি মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করলেও এখন পর্যন্ত এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি। বিভিন্ন পত্রিকা, মামলা ও অভিযোগের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে নিবন্ধিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার ৪৫৫ জন। এদের মধ্যে শিশু ১৩৫ জন। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১১ জন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালের শুধু ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৬৩টি। জানুয়ারিতে ৫৫টি। ২০১৭ সনের প্রথম ১০ মাসে ধর্ষণসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৩৭টি। গত বছর ১২ মাসে একই ধরণের ঘটনার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৫৩টি। সে হিসেবে এসব ঘটনা বেড়েছে ২৮৪টি।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ধর্ষণসহ যত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। বিচারের হার এক শতাংশেরও কম। ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর মাত্র ২ শতাংশ ধর্ষণ মামলার বিচার হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করার পর খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।’ একই সঙ্গে সর্বনিম্ন জরিমানা ১ লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড কমপক্ষে ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে’।

এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার পরে এতো এতো ধর্ষণ হয়ে গেলো; হয়তো কাল আরও একটা হবে; হয়তো আপনার স্ত্রী-ই ধর্ষণের শিকার হবেন কিংবা আপনার কন্যা কিংবা আপনার বোন কিংবা আপনার মা-খালা-ফুপু! কিংবা আপনি নিজেই ধর্ষক হবেন।

১৯৭১ সালে তিন লাখ মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিরিশ লাখ প্রাণের সাথে, যুদ্ধ শেষে নির্যাতিতা নারীরা যখন জাতির পিতার কাছে গিয়েছিলেন, পিতা তাদের বাবার নামের জায়গায় নিজের নাম লিখে দিতে বলেছিলেন। আজ স্বাধীনতার ৪৭ বছর যাচ্ছে, দেশে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে; আজ ধর্ষণের শিকার মেয়েরা শেষ বিচারটুকু পান না।

দেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ, দেশে আজ উন্নয়নের জোয়ার; দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আকাশচুম্বী হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা; শুধু আমরা এই ১৬ কোটি মানুষ নির্লজ্জ আর বেহায়া হচ্ছি।

আসুন আমরা লজ্জা পাই; সোনার বাংলায় আমরা সেই সামান্য নিরাপত্তা মেয়েদের দিতে পারি না, কিন্তু আমরা লজ্জা তো পেতেই পারি। নিজেদের ধিক্কার তো দিতেই পারি, না?
আমরা কবে মানুষ হবো!

বিশ্বাস করুন, লাল জামা পড়ে গা এলিয়ে সবুজ মাঠে শুয়ে থাকা মেয়েটা আজ আমাদের অভিশাপ দিয়ে গেলো।

চলুন, লজ্জিত হই; বড় নির্লজ্জ হয়েছি আজকাল আমরা সবাই।

শেয়ার করুন: