নষ্টনীড় এর চারু: একজন একলা মানুষ

ইশরাত জাহান ঊর্মি:

…এইরূপে সে যতদিন কাগজ লইয়া ভোর হইয়া ছিল ততদিনে তাহার বালিকা বধূ চারুলতা ধীরে ধীরে যৌবনে পর্দাপণ করিল। খবরের কাগজের সম্পাদক এই মস্ত খবরটি ভালো করিয়া টের পাইল না। ভারত গবর্মেন্টের সীমান্তনীতি ক্রমশই স্ফীত হইয়া সংযমের বন্ধন বিদীর্ণ করিবার দিকে যাইতেছে, ইহাই তাহার প্রধান লক্ষ্যের বিষয় ছিল।
ধনীগৃহে চারুলতার কোনো কর্ম ছিল না। ফলপরিণামহীন ফুলের মতো পরিপূর্ণ অনাবশ্যকতার মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠাই তাহার চেষ্টাশূন্য দীর্ঘ দিনরাত্রির একমাত্র কাজ ছিল। তাহার কোনো অভাব ছিল না।
নষ্টনীড়-এ শুরুতে চারুলতাকে এইভাবেই আনা হলো।

আমরা দেখলাম, “লেখাপড়ার দিকে চারুলতার একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল বলিয়া তাহার দিনগুলা অত্যন্ত বোঝা হইয়া উঠে নাই।”
কিন্তু একটু ভেতরগুটানো, একলা থাকা, নিজের মনে গান গাওয়া আর বাংলা বই পড়া চারুলতা যতই আমাদের সামনে স্পষ্ট হতে থাকলেন, ততই যেন কাদম্বরী দেবী নামে ঠাকুর পরিবারের বহুল চর্চিত আরেকটি চরিত্রও আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাতড়ে হাতড়ে আমরা ঠিকই বুঝতে পারলাম আসলে কে এই বৌঠান।

ভূপতির পিসতুতো ভাই অমল থার্ড-ইয়ারে পড়িতেছিল, চারুলতা তাহাকে ধরিয়া পড়া করিয়া লইত; এই কর্মটুকু আদায় করিয়া লইবার জন্য অমলের অনেক আবদার তাহাকে সহ্য করিতে হইত। তাহাকে প্রায়ই হোটেলে খাইবার খোরাকি এবং ইংরেজি সাহিত্যগ্রন্থ কিনিবার খরচা জোগাইতে হইত। অমল মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইত, সেই যজ্ঞ-সমাধার ভার গুরুদক্ষিণার স্বরূপ চারুলতা নিজে গ্রহণ করিত। ভূপতি চারুলতার প্রতি কোনো দাবি করিত না, কিন্তু সামান্য একটু পড়াইয়া পিসতুতো ভাই অমলের দাবির অন্ত ছিল না। তাহা লইয়া চারুলতা প্রায় মাঝে মাঝে কৃত্রিম কোপ এবং বিদ্রোহ প্রকাশ করিত; কিন্তু কোনো একটা লোকের কোনো কাজে আসা এবং স্নেহের উপদ্রব সহ্য করা তাহার পক্ষে অত্যাবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল।
এইবার রবীন্দ্রনাথ সামনে আসলেন কি না বলেন তো? নষ্টনীড়কে সবচেয়ে ভালো আঁকতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এতোটা স্পষ্ট আর ভিতরজয়ী আর কোন বাংলা সিনেমা হয়েছে কিনা আমার দেখায় নেই।

তো, সেই সিনেমায় একলা চারুর জীবনে ঠাকুরপো কিভাবে আসে? ঝড়ের বিকেলে, সবকিছু উথালপাথাল করা, উড়িয়ে নেয়া বিকেলে, ঝড়ের শব্দ, বাঁধ আর পাল-হাল ভাঙার শব্দের ভেতর অমলরূপী সৌমিত্র চট্টোপোধ্যায় দীপ্ত চেহারায় সামনে দাঁড়ায়। আসলে বুঝি রবীন্দ্রনাথকেই এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর চারুর চোখের সেই উত্তেজনা? আহ!

অমল কহিল, ‘বউঠান, আমাদের কলেজের রাজবাড়ির জামাইবাবু রাজঅন্তঃপুরের খাস হাতের বুননি কার্পেটের জুতো পরে আসে, আমার তো সহ্য হয় না– একজোড়া কার্পেটের জুতো চাই, নইলে কোনোমতেই পদমর্যাদা রক্ষা করতে পারছি নে।’
চারু। হাঁ, তাই বৈকি! আমি বসে বসে তোমার জুতো সেলাই করে মরি। দাম দিচ্ছি, বাজার থেকে কিনে আনো গে যাও।
অমল বলিল, ‘সেটি হচ্ছে না।’

চারু জুতা সেলাই করিতে জানে না, এবং অমলের কাছে সে কথা স্বীকার করিতেও চাহে না। কিন্তু তাহার কাছে কেহ কিছু চায় না, অমল চায়– সংসারে সেই একমাত্র প্রার্থীর আবদার রক্ষা না করিয়া সে থাকিতে পারে না। অমল যে সময় কলেজে যাইত সেই সময়ে সে লুকাইয়া বহু যত্নে কার্পেটের সেলাই শিখিতে লাগিল। এবং অমল নিজে যখন তাহার জুতার দরবার সম্পূর্ণ ভুলিয়া বসিয়াছে এমন সময় একদিন সন্ধ্যাবেলায় চারু তাহাকে নিমন্ত্রণ করিল।

গ্রীষ্মের সময় ছাদের উপর আসন করিয়া অমলের আহারের জায়গা করা হইয়াছে। বালি উড়িয়া পড়িবার ভয়ে পিতলের ঢাকনায় থালা ঢাকা রহিয়াছে। অমল কালেজের বেশ পরিত্যাগ করিয়া মুখ ধুইয়া ফিট্ফাট্ হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল।
অমল আসনে বসিয়া ঢাকনা খুলিল; দেখিল, থালায় একজোড়া নূতন-বাঁধানো পশমের জুতা সাজানো রহিয়াছে। চারুলতা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল।

জুতা পাইয়া অমলের আশা আরো বাড়িয়া উঠিল। এখন গলাবন্ধ চাই, রেশমের রুমালে ফুলকাটা পাড় সেলাই করিয়া দিতে হইবে, তাহার বাহিরের ঘরে বসিবার বড়ো কেদারায় তেলের দাগ নিবারণের জন্য একটা কাজ-করা আবরণ আবশ্যক।
এইসব ছবিতে কি পাই আমরা? নেহায়েত বৌঠান আর দেবরের খুনসুঁটি? না কি একলা, সন্তানহীনা চারুলতা সমগ্র! তার স্বামী ভালোমানুষ, জ্ঞানী আর সমাজ আদরণীয়। তার সময় নেই দিনে দিনে মনে-শরীরে পরিস্ফূট হওয়া তরুণী ভার্যার দিকে নজর দেবার।

সে মানুষ খারাপ নয়, কিন্তু মনের দূরত্ব এক অদ্ভুত জিনিস। একা একা বাংলা নভেল পড়া, ঘর সাজানো, সূক্ষ্ম রুচির দারুণ অন্তর্মুখী চারুকে যে জ্ঞানী আর ভালোমানুষ ভূপতি ধরতেই পারেননি কখনও তা তিনিও জানতেন না। রবীন্দ্রনাথ জানতেন। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথ কখনও কখনও নারী চরিত্র আঁকায় এমন মুনশী যে চমকে উঠতে হয়। আর চারুলতা কাদম্বরীর ছায়া বলেই আরও জীবন্ত, আরও স্পর্শী, সম্ভবত।

কাদম্বরীর কথা পড়ে যেটুকু জানা যায় তাতে স্বামীর তুলনায় কিছুটা নিস্প্রভ ছিলেন তিনি। নষ্টনীড় এ চারু ঠিক নিষ্প্রভ নয়, তবে ঐ যে ভিতরগামী। তার একাকীত্ব ঘোচানোর চেষ্টায় ভূপতি শ্যালক এর স্ত্রী মন্দাকে নিয়ে আসেন।

কিন্তু গল্পে যেমন, সিনেমাতেও তেমন চারুর সাথে ঠিক যায় না মন্দার।

মন্দা সাধারণ নারী, চারুর অসাধারণত্ব পাঠকের সামনে ইতিমধ্যেই পরিস্কার। মন্দাকে, তার সাধারণত্বকে একরকম প্রশ্রয় আর করুণার চোখে দেখে চারু, আর অমল বাঁধতে লাগে খেলাঘর। অযত্নে পড়ে থাকা বাগান তারা কল্পনায় নতুন করে সাজায়। আর দুজনের লেখালেখি। এই জগতে মন্দার মতো সাধারণের প্রবেশ নাই। প্রেম আর সৃজনশীলতা একতারে বাজলে সেই প্রেমের মতো উত্তুঙ্গ আর কিছু হয় না। যতই দিন যায় চারুর ভাবালুতা বাড়ে।

কিন্তু প্রথম ধাক্কা আসে দুজনের জগতের সেই লেখালেখি নিয়েই। অমল যখন লিখে খ্যাতি পাচ্ছে তখন আর খেলাঘরের একমাত্র সাথীতে সে খুশী থাকে না। পাঠকের কাছে পৌঁছানোর তাগিদে লেখাটাকে আরও দশজনের করে তোলে সে। মন্দাকেও সে নিজের লেখার পাঠক বানায়। অন্ত:সলিলা আর সুপার সেনসেটিভ চারুর এতে অভিমান হয়। অন্যরকমের অভিমান। মন্দা আর অমলের আরও আরও পাঠিকার থেকে তার যে পার্থক্য আছে, সেটা বোঝাতে সেও লেখালেখি শুরু করে। তারপর তার লেখাও যখন ছাপা হয় তখন দুজনের ভেতরের দূরত্ব না কমে বরং আরও বেড়ে চলে। আর মন্দাকে নিয়ে প্রেমিকা চারুর ঈর্ষাও বেড়ে চলে। লাভ কিছু হয় না।

অমল নারীর মন বুঝতে পারে। কাছের মানুষের কাছে ঠকে যাওয়া বিষয়বুদ্ধিহীন ভূপতি যখন অর্থকষ্টে পড়ে সাধের খবরের কাগজ তুলে দেবে বলে ঠিক করে, তখন এইসব বাগান-বাগান, লেখা-লেখা খেলাকে আর “পুরুষোচিত” মনে হয় না অমলের কাছে। দাদাকে সাহায্য করতে সে বিয়ে করে বিলেত চলে যায়। চারুর সাথে যা কিছু ছিল তার সমস্তকিছু অবহেলায় আর হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে।

অমলরা তো চলেই যায়। চারু? চারু কী করে এবার?
অমলের শরীর ভালো আছে তবু সে চিঠি লেখে না! একেবারে এমন নিদারুণ ছাড়াছাড়ি হইল কি করিয়া! একবার মুখোমুখি এই প্রশ্নটার জবাব লইয়া আসতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু মধ্যে সমুদ্র-পার হইবার কোন পথ নাই। নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ, নিরুপায় বিচ্ছেদ, সকল প্রশ্ন সকল প্রতিকারের অতীত বিচ্ছেদ।
চারু আপনাকে আর খাড়া রাখিতে পারে না।
একসময় চারু ধরা পড়ে যায় আলাভোলা স্বামী ভূপতির কাছেও।

চারু কি ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছিল? প্রেমে পড়ার জন্য সে কি উদগ্রিব হয়ে ছিল? চারুলতাকে দেখবার ক্ষেত্রে প্রথাগত সম্পর্কের ছাঁচ থেকে বের হয়ে অন্য এক সম্পর্কের ঘোরে পড়ার বিষয়টি আমাকে টানে। আর টানে সম্পর্ককে সজীব রাখতে তার এই লেখা আর বাগান করার পরিভ্রমণ। আসলে এটা তো লেখালেখি নয়, বাগান করা নয়, এটা হলো সম্পর্ককে নতুন রাখার উপায় আবিষ্কার। চারু তাই করেছিল।

কিন্তু ভুল মানুষের প্রেম তাকে ভোগায়। নারীর দায়, নারীর ব্যথা অব্যাখ্যেয়। খুব সজীব-সতেজ, আলো হাওয়ার অমল যখন হঠাৎ ফরমাল একটা সম্পর্কের পোশাক পরে, শীতল আচরণ করে, “পার হইবার উপায় নাই” সমুদ্ররে ওপাড়ে চলে যায়, চারু কিন্তু বলতে পারে না তার তোলপাড় করা প্রেমের কথা।

ইশরাত জাহান ঊর্মি

“কথা কহিতে কহিতে তাকে কাঁদিবার জন্য উঠিয়া যাইতে হইতো” তবু এরই মধ্যে সে সংসার করে, স্বামীর জন্য ডিমের কচুরী ভাজে। সে একটা নিজস্ব জগত গড়ে তোলে যেখানে “সংসারের সকল ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া নিজের অনাবৃত আত্মস্বরূপে প্রবেশ করে এবং সেখান হইতে বাহির হইয়া মুখোশখানা আবার মুখে দিয়া পৃথিবীর হাস্যালাপ ও ক্রিয়াকর্মের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হয়।”

আর এদিকে পত্রিকা তুলে দিয়ে, নানাদিক থেকে ঘা খাওয়া বিশ্বাসপরায়ণ ভূপতির মনে “বহি:সংসারের প্রতি বৈরাগ্যের ভাব” এলে সে চারুর কাছে ফিরতে চায়। কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে। প্রেমের হৃদয়। নারী এবং সময় যখন যায়, তখন আর ফিরে আসার জন্য যায় না।

চারুকে ভূপতি কোনদিন বোঝেননি, বা বুঝেছেন তাঁর মতো করে। ভূপতির সাধারণ সংস্কার-স্ত্রীর উপর অধিকার কাহাকেও অর্জন করিতে হয় না, স্ত্রী ধ্রুবতারার মতো নিজের আলো নিজেই জ্বালাইয়া রাখে-হাওয়ায় নেবে না, তেলের অপেক্ষা রাখে না।”
চারুর জগৎ, চারুর একাকীত্ব, চারুর সরল বাংলা এবং চারুর জীবন-সব জায়গাতেই প্রবেশ করতে দেরী হয়ে গিয়েছিল ভূপতির। চারু তাকে কতটুকু আর সে চারুকে কতটুকু গ্রহণ করে শেষপর্যন্ত তা অস্বচ্ছই থেকে যায়।
চারু এবং তার প্রেম শেষপর্যন্ত এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

এখনও এই সমাজে অনেক চারু’র সম্পর্কই প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ভালো, উদার, শিক্ষিত, বিবেচক “স্বামী” থাকা সত্ত্বেও আগাছা নিংড়ে বাগান সাজানোর জন্য যারা “অমল”দের খুঁজে ফেরেন। সেই অমলরাও শেষপর্যন্ত পুরুষই। আরও আরও দায়-দায়িত্বে তারা চারুদের ত্যাগ করে। আর চারুরাও শেষপর্যন্ত একটা “নষ্টনীড়” এ আধামানবের জীবন কাটিয়ে যায়। এ গল্প তাই চিরকালীন। চারুরাও!

শেয়ার করুন: