আমার যখন কষ্ট হয় …

নাসরিন আক্তার:

আমি প্রতিনিয়ত কষ্ট পাই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে কষ্ট পাই। হোস্টেলে রুমমেটদের সাথে কথা বলতে গেলে কষ্ট পাই। খবর পড়তে গেলে কষ্ট পাই। টিভি চালু করলেই কষ্ট পাই। শপিংএ গেলে কষ্ট পাই। বাড়িতে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে যতই সতর্ক থাকি না কেন, তবুও কষ্ট পাই। বাড়িতে গেলে পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলতে গেলে কষ্ট পাই।

আমি কষ্ট পাই যখন রাস্তায় চলতে গেলে পাশের পুরুষটি তার ওপাশে হাজার ফুট জায়গা থাকা সত্ত্বেও আমার গা ঘেঁষে চলে যায়, আমার গায়ের কোনো অংশে ইচ্ছাকৃতভাবে চাপ দিয়ে চলে যায়। আমার ভীষণ কষ্ট হয় যখন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কোনো মেয়ের গায়ের কাপড় ব্লেড দিয়ে কেটে দেয়ার কথা শুনি, বিভিন্ন জাতীয় উৎসবগুলোতে একজোট হয়ে শকুনের দল কোনো নারীর উপর হামলে পড়েছিলো বলে শুনি।

আমার ভীষণ কষ্ট হয় যখন পত্রিকার পাতা খুলেই দেখি দেশে ৮২ ভাগ বিবাহিত নারীই নির্যাতনের শিকার (সমকাল, ৬ মার্চ ২০১৮), দেশে ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির ন্যায় বৃদ্ধিমান। বাসে, ট্রাকে, মাইক্রোবাসে, ঘরে, বাইরে, আলোতে, অন্ধকারে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলছে এসব ধর্ষণ, গণধর্ষণ, মা-মেয়েকে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের পর হত্যা। উল্লেখ করে রাখি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪ হাজার ৩০৪ জন নারী। আর তার মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে (প্রথম আলো অনলাইন, ২৬ মার্চ ২০১৬)।

সবচেয়ে ভয়ংকর কথা কি জানেন, এই যে নারী এভাবে ধর্ষণের শিকার হয়, নির্যাতিত হয়, এর জন্য আবার দায়ী নাকি সেই নির্যাতিত নারীরাই। কারণ হচ্ছে তারা নাকি জামা কাপড় ঠিকমতো পরে নাই, হায়াওয়ালাদের মতো চলাফেরা করে নাই। যারা এই কথা বলেন, তাদেরকে বলছি, কই আপনারা তো হজ্বে গিয়েও সাত পর্দায় ঢেকে থাকা মেয়েদেরও বাদ দেন নাই টিজ করতে, হ্যারাস করতে, ছয় মাসের শিশু থেকে ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,১০ বছরের শিশুকেও বাদ দেন নাই।

ও আচ্ছা মনে পড়ে গেলো। এই ক্ষেত্রে নাকি আপনারা যুক্তি দেন এই বলে যে, বেহায়া মেয়েদের দেখে জেগে ওঠা কাম নাকি দমাতে না পেরে আপনারা এই হায়াওয়ালা আর হায়া হওয়ার বয়স না হয়ে উঠাদের উপর ঝেড়েছিলেন!!

আমার কষ্টে পুড়ে যেতে ইচ্ছা করে যখন টেলিভিশন খুলতেই দেখি নারী পুরুষের অসম উপস্থাপন। সেখানে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন, সিনেমা, নাটক আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চলছে নারী পুরুষ সম্পর্কিত আজগুবি সব পুরুষতান্ত্রিক, নয়া পুরুষতান্ত্রিক, গৎবাঁধা, ছাঁচিবদ্ধ ধারণার উৎপাদন। সেখানেও দেখানো হয় নারী ফর্সা না হলে তার বিয়ে হয় না, চাকরি হয় না। তার যেন সৌন্দর্যই শুধু দরকার, এই সবচেয়ে বড় গুন, টিকে থাকার একমাত্র হাতিয়ার কারণ এখানে পুরুষগুলোকে দেখানো হয় বর্ণান্ধ করে। ফলে আমি কষ্ট পাই কিন্তু অবাক হই না যখন আমার প্রকৌশলী বান্ধবী, অর্থনীতি পড়া বান্ধবী, সাংবাদিকতা পড়া বান্ধবীরা আরও কেন ফর্সা নয় সেই নিয়ে আফসোস করে, পার্লারে গিয়ে ব্লিচ করে আসে।

আমার কষ্ট লাগে যখন আমার মন্ত্রণালয়ে চাকরি করা রুমমেট সদা সর্বদা কানের কাছে বর আর বরের বাড়ির গল্প করে করে আমার মাথা নষ্ট করে দেয়। ভীষণ কষ্ট লাগে যখন আমার ইয়োগামেটরা একেকজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করা সত্ত্বেও নিজের উপর প্রত্যয় হারিয়ে স্বামীর মন মতো বডি তৈরিতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে তাদের কষ্ট ভরা মন নিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে তাদের হাজবেন্ডদেরও কী পর্বত সমান পেট নেই!

আমার কষ্ট লাগে আমার পাড়া প্রতিবেশীদের আমার প্রতি গায়ে পরা দরদ দেখে। যখন আমার নিকটাত্মীয়া তার মেয়ের দুটো বাচ্চাকে দেখিয়ে আমাকে সকরুণ জিজ্ঞেস করে, ‘‘তোমারও কি ইচ্ছা করে না এমন বিয়ে করে সংসারী হয়ে এমন দুটো বাচ্চা নিতে’’ তখন আমার ভয়ংকর কষ্ট হয় মুখে আসা বেফাঁস জবাবটাকে নিজের ভেতরে চেপে রাখতে।

আমার মায়ের নাকি রাতে ঘুম হয় না। কেন? আমার বিয়ের চিন্তা নিয়ে। এতো বয়স হয়ে গিয়েছে, অথচ কেনো বিয়ে করছি না তাতে তার ভীষণ কষ্ট হয়। তার এমন কষ্ট দেখে আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। আমি তাকে যতোই বোঝাই সে ততোই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে।

সেদিন আমার বড় ভাইসম কলিগ বলছে, তার কাছে নাকি আমার ছোটোভাই বলেছে আমার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে। শুনে আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। কষ্ট লাগে আমার তাদের কষ্ট পাওয়া নিয়ে, আমার ইচ্ছাটা তাদের সাথে মেলে না বলে। এই সমাজে একটি মেয়েকে বিয়ে করতেই হবে, সংসারী হতেই হবে, সন্তান জন্ম দিতেই হবে সেটা সেই মেয়ের ইচ্ছে করুক বা না করুক।

আমার আরো কষ্ট লাগে যখন দেখি কিছু মানুষ নারীমুক্তির কথা বলে, কিন্তু সেই মুক্তির সাথে নারীর শরীরের মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলে। এদের দেখলে কষ্ট হয় সাথে ঘেন্নাও হয়।

কর্মজীবী মেয়েদের নিয়ে বেশ কয়েকজনকে এই কথাটি বলতে শুনেছি, মেয়েরা নাকি শুধু তাদের ড্রেস কেনার জন্য, তাদের লিপস্টিক কেনার জন্য, আর পার্লারে খরচ করার জন্য চাকরি করে। ভাই, কয়টা মেয়েকে চেনেন, জানেন আপনারা? দেশের সর্বত্র এখন বহু মেয়েকে পাবেন যারা তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।

এই মেয়েদের কথা তো আপনারা বলেন না। বলবেনই বা কেনো। বললে তো আপনাদের একার যে কাজে কৃতিত্ব সেটা ভাগ হয়ে যাবে।

লেখক: স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর জার্নালিজম, কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক

শেয়ার করুন: