পুলক ঘটক:
‘ধর্ষক দায়ী নয়, ধর্ষিতাই দায়ী’ – এই ধারণায় যারা বিশ্বাস করে ও প্রচার করে তারা সমাজে প্রবল হয়ে উঠছে। যখন মোশারফ করিমের মতো জনপ্রিয় অভিনেতাকে সত্য বচন থেকে সরে আসতে হয় ও দুঃখ প্রকাশ করতে হয়, তখন বুঝতে হবে ধর্ষক ও ধর্ষকের সমর্থক গোষ্ঠী কতোটা শক্তিশালী! সমাজটা ধর্ষক ও ধর্ষকের সমর্থকদের হাতে তুলে দিলে সভ্য মানুষের বসবাসের জায়গা থাকবে না। সুতরাং বাঁচার জন্য হলেও আমাদের কথা বলতে হবে।
তাই আমি জোরের সাথে বলছি, ধর্ষণের জন্য নারী ও নারীর পোশাক মোটেই দায়ী নয়। ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য ধর্ষক নিজেই দায়ী। ধর্ষণের জন্য পুরুষও দায়ী নয়; দায়ী পুরুষতান্ত্রিক মন মানসিকতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দায়ী। নারী-পুরুষ সমতা ও সমমর্যাদা সম্পন্ন একটি সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রেম ও পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন মিলন থাকবে। কিন্তু নারীর উপর অন্যায় অধিকার ফলানো, জোরজবরদস্তি ও নারী নিগ্রহের সমাজ-মনস্তত্ত্ব থাকবে না।
সমতাপূর্ণ সমাজ গড়তে পারলে ধর্ষণের মতো অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে যাবে। এরকম অপরাধ সমাজের ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হবে। বিদ্যমান সমাজে ধর্ষণ একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং এর জন্য নারী, নারীর পোশাক ও নারীর স্বাধীনতাকে দায়ী করার সংস্কৃতি চালু আছে। এগুলি কুশিক্ষা ও অপবিশ্বাসের ফল। কুশিক্ষা ও অপবিশ্বাস যত ছড়াচ্ছে, ততই অপরাধ বাড়ছে। গত ২০ বছরে অপবিশ্বাস প্রবল হয়েছে। অপবিশ্বাস যত প্রবল হয়েছে, ঘুষ-দুর্নীতি-অমানবিকতা-সাম্প্রদায়িকতা-ধর্ষণ ততই বেড়েছে।
দেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই ধার্মিক। সকল ধর্মের মানুষ তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস রক্ষায় দিন দিন অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ, অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও প্রবল হয়ে উঠছে। ধর্মচর্চাও দিন দিন বাড়ছে। মানুষ ধার্মিক হওয়ার সাথে সাথে অপরাধ কমে যাওয়ার কথা। কমছে না কেন? এখন যতো মসজিদ ও মন্দির দেখা যায়, ২০ বছর আগে ততো ছিল না। এখন যতো ধর্মসভা হয় এবং ধর্মীয় প্রার্থনা ও পাঠচক্র হয়, অতীতে ততো হতো না। কিন্তু কী দেখছি? ধর্মচর্চার সাথে সমান তালে ঘুষ, দুর্নীতি, অমানবিকতা ও ধর্ষণ বাড়ছে। এটা তো হওয়ার কথা নয়।
এদেশে হিন্দু-মুসলমান সবাই ধার্মিক। এখানে তো নারীদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই! রাত ১২ টার পর একজন নারী প্রয়োজনে যেকোনো স্থানে একাকি যাবে, চলাচল করবে – ভয়ের কোনো কারণ দেখি না। কারণ সবাই ধার্মিক! এখানে ভয়ের কী আছে? ভয় পাওয়ার কথা সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, চীনের মতো দেশে। কারণ সে সব দেশের মানুষ এতো ধার্মিক নয়। কিন্তু আমরা কী দেখি? সুইডেনে একজন নারীর চলাচল ও পুরুষের চলাচলের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। সেখানে স্বাধীনভাবে চলতে নারীকে ভয় পেতে হয় না।
আমাদের এই ধার্মিকদের দেশে কেন ভয় পেতে হয়? বলবেন, ‘নারীর পোশাকের কারণে’? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনার মেয়ে, বোন বা স্ত্রী বোরকা পরলেই কি নিরাপদ? মেয়ে বোরকা/হিজাব পরে রাত ৮ টার পর ঢাকা থেকে দেশের যে কোনো জেলায় রওনা দিলে আপনি টেনশনে থাকবেন কিনা বলুন? বাড়ির পুরুষলোক একাকি বাইরে গেলে দু:শ্চিন্তা হবে, নাকি একজন নারী একাকি বাইরে গেলে দু:শ্চিন্তা হবে? আপনি নারীকে ভারী পোশাকের আবরণে ঢেকে দিলেন, এবং যে সমাজে কাজের জন্য পাঠালেন সেই সমাজের মানুষও ধার্মিক – তাহলে আর চিন্তা কেন?
পোশাকের কারণে নারী ধর্ষিত হয়? তাহলে ছয় বছরের শিশু কেন ধর্ষিত হবে? নারীর কথা বাদ দেন। ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী হলে, পুরুষ কেন ধর্ষিত হবে? ধর্ম যদি বর্ম হয়, তাহলে মোল্লা-পুরুতের শরীর ও মন ধর্ষক হয়ে ওঠে কীভাবে? বড় হুজুরের হাতে মাদ্রাসা ছাত্র কীভাবে ধর্ষিত হয়? মাদ্রাসা ছাত্রদের কি পোশাক দিয়ে রক্ষা করবেন?
আমাদের দেশের ৯৯% নারী নিজের স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে বাধ্য হলেও বাঙালি নারীরা স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে না। নারীকে কোন পোশাক পরিয়ে তার স্বামীর কবল থেকে রক্ষা করবেন?
পোশাককে দায়ী করছেন? স্লিভলেস ব্লাউজের জন্য কিংবা জিন্সের পোশাক পরিধানের জন্য আধুনিক নারীকে কটাক্ষ করছেন? খোঁজ নিয়ে জানুন, আপনার মা-দাদী-নানী তাদের যৌবনে ব্লাউজ পরতেন কিনা? এই পোশাকের ইতিহাস কী? কত বছর আগে এই পোশাক আবিস্কার হয়েছে? সুতার আবিস্কার কত সালে? রেশমের আবিস্কার কত সালে? সূতি বস্ত্রের আবিস্কার কত সালে? কর্ড, ডেনিম, জিন্স কবে এসেছে? আধুনিক হবেন, না পশ্চাদপদ হবেন? পোশাক তৈরির আধুনিক যন্ত্র কবে আবিস্কার হয়েছে? বাঙালি নারী ব্লাউজ পরতে শিখেছে কত বছর আগে?
আমি গ্রামের মেয়েদের গামছা পরতে দেখেছি। সেটা বেশিদিন আগের কথা নয়। মাঠে, ঘাটে ও রাস্তার ধারে নারীদের প্রাকৃতিক কর্ম করতে দেখেছি। সেটাই আধুনিকতা, নাকি টয়লেট ব্যবহার করা আধুনিকতা? একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের নারীরা কোথাও বেড়াতে না গেলে ব্লাউজ পরতেন না। শুধু শাড়ি পরতেন। পেটিকোট এবং ব্লাউজসহ শাড়ি পরতেন গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল পরিবারের নারীরা। তাও সার্বক্ষণিক নয়। এখন উন্নত পোশাক আবিস্কার হয়েছে। মানুষ আধুনিক হয়েছে বলেই উন্নত পোশাক পরছে। নতুন ডিজাইন, উন্নত পোশাক ও প্রসাধনী মানুষকে সুদর্শন ও পরিশীলিত করেছে।
আধুনিকতাই বরণীয়। উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান বরণীয়। মানুষের কাজের ধরন, উপযোগিতা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ এবং সর্বোপরি জলবায়ু ও আবহাওয়ার উপর পোশাক পরিচ্ছদ নির্ভর করে। শীতপ্রধান দেশে আপনি ধুতি, লুঙি, শাড়ি, বোরকা ইত্যাদি পরে প্রাণ বাঁচাতে পারবেন না। উন্নত শীতবস্ত্র লাগবে। এর সাথে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই।
আপনি আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পোশাক পরুন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ধর্ষকের ও নিজের ধর্ষক মানসিকতার দায় ধর্ষিত নারী-পুরুষের উপর চাপাবেন না। সেটা করলে আপনিও ধর্ষক। ভালো হয়ে যান।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।