শায়লা হক তানজু:
রোজ শুতে যাওয়ার আগে মাকে ফোন দেই, মন ভালো হওয়ার বদলে খারাপ হয়ে যায়, আমাদের বাবা-মায়েরা অভিভাবক হতে গিয়ে বন্ধু হতে পারেনি কোনদিনও। আমার মনে পড়ে না শেষ কবে আমার বাবা আমায় জড়িয়ে ধরেছিলো, আমার কোনো কান্না না গিলে, বাথরুমে না লুকিয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলাম!
বাবার দেওয়া এ জীবন ছাড়া কোন উপহারও নেই। এর মানে এই না বাবা-মা আমাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসা প্রকাশ করতে শেখায় না আমাদের অসুস্হ রক্ষনশীল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। বাচ্চারা জড়িয়ে ধরার উষ্ণতা বোঝে, ভালোবাসি বলার মমতা বোঝে, চুমুর স্পর্শ বোঝে, আমি কোনদিনও বাবা-মা এর লক্ষী পয়মন্ত মেয়ে ছিলাম না, আমি বরাবরি প্রবলেম চাইল্ড ছিলাম, প্রকাশহীন ভালোবাসা, আস্হাহীন সম্পর্ক, আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসুস্থ বানায়, আমিও ঠিক ভালোবাসার প্রকাশ জানি না।
নিজেদের প্রত্যাশার বোঝা, সন্তানের পরীক্ষার রেজাল্টকে প্লিজ নিজের অফিস কলিগদের সাথে ইগো ইস্যু বানাবেন না। আমার মা আজো বুঝে না, সারাদিনের ক্লান্তির পর দু’দণ্ড শান্তির জন্যে তাকে ফোন দেই, বদলে একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে কথোপকথন শেষ হয়, এ বয়সে তাদের একা করে দূরে থাকি আমরা দু বোন। ছেলে থাকলে ছেলের বৌ এর সাথে থাকতো। আমার ছেলেটার দুষ্টুমি, কাজের লোক না পাওয়া, আমার বিয়ে না হওয়া, এসব শুনে শুনে নিজেকে খুব বিপন্ন লাগে। কারণ একটা সমস্যারও সমাধান আমি জানি না। এতোকিছুর পরও কেনো আমার মা এর মনে হয় একটা বিয়েই আমার সকল দুঃখের অবসান ঘটাবে!
কোনদিন জিজ্ঞ্যেসও করে না, কেমন আছি? কী খেয়েছি,? বিয়ে করা কি এতো সোজা, মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রেমহীন বিয়ে শুধু সমাজের শর্ত পূরণের জন্যে। আর বিয়ে, সেও তো লোক দেখানো সুখ, কাবিন, গয়না, ফার্নিচার নিয়ে দর কষাকষি। ভাবী, আমার মেয়ের জামাই এটা করে, অত মাইনে পায়- এসব বলাটাই যেন বড় দরকারি, সারা জীবন শুনেছি, ওর মেয়ে পারলে তুই পারবি না কেন? সারাজীবন শুনেছি, আমি একটা অচল পয়সা, মাথা নষ্ট, আমি কোনভাবে ঐ চিটাগোনিয়ান, টিপিক্যাল দুবাইওয়ালা পরিবারের চলনসই পয়সা হতে পারিনি, হতে চাইও না।
কিন্তু মা, তুমি তো সোশিওলজির ছাত্রী, আশুতোষ তোমার প্রিয় বই, বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছো পড়াশোনা করতে, কবি মা আমার, তুমি কেন এমন পাল্টে গেলে? যে ভালোবাসা চাপিয়ে দেয় দখলদারিত্ব, আমি কই যাবো মা, সবাই শুধু আমায় দখল করতে চেয়েছে। আমার বন্ধুত্বহীন ছেলেবেলা ছিলো উদভ্রান্ত, দিশেহারা, ভীত, আমি আশ্রয় খুঁজেছি বাইরে, জানতাম না কাকে বলবো আমার শৈশব-কৈশোরের শংকা, দ্বিধার কথা, আমি কোনদিন ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনি আমার মনের কথা আমার মাকে। একি শুধু আমারই ব্যর্থতা?
প্লিজ সন্তানের উপর নিজের প্রত্যাশার বোঝা চাপাবেন না, বাবা-মা হওয়ার আগে বন্ধু হোন, নাহয় অনেকেই সেই দ্বিধান্বিত কিশোর বা কিশোরীর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিবে। আমি আজো প্রতিটা রাত অনিশ্চয়তায় কাটাই, তার বীজ আমার শৈশব, কৈশোরে বোনা। ভালোবাসা যে প্রকাশ করতে হয়, আমার বাবা-মা এর অপ্রকাশিত, গতানুগতিক ভালোবাসা বুঝতে বুঝতে আমার মনোজগৎ ছিঁড়ে-বিড়ে গেছে। মাঝখানে যে পাহারসমান দেয়াল আর দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা আর এজন্মে পেরোনো হবে না।
সত্যিটা হলো আমার বাবা-মা আমাদের জন্যে বেঁচেছেন সারাজীবন, তার বদলে তারাও সেটা চান, কিন্তু এটা যে আমারও জীবন। আমার বাবা সরকারি চাকরির সাথে একসময় পারিবারিক ব্যবসা করতো, ভয়ংকর পরিশ্রম করতো, আমি স্কুলে পড়ি, মাও সরকারি চাকরি করতো, অফিসে বসে ও কাজের ফাঁকে আমার স্কুলের নোট করতো। ছোট ছোট সব বিষয় তার নখদর্পনে ছিলো, অসম্ভব গোছানো আর বসি মানুষ।
ছুটির সকালে ছোট বোনের প্রিয় খিচুরি, আমার পরোটা, বাবার মোরগ পোলাও মিস হতো না। কোনো পরীক্ষা থাকলে আমার চেয়েও বেশি টেনশন করতো আমার মা। পিকনিকে যাবো, কিন্তু চুলটা কিভাবে বাঁধবো, কোন জামাটা পরবো, সব মা-ই ঠিক করতো, আরবী জোব্বা টাইপ, অনেক জরি, চুমকিওয়ালা, আলিফ লায়লা টাইপ জামা পরতে হতো, এসবই ভালোবাসা, কিন্তু ঐ বয়সে আমার অত্যাচার মনে হতো।
আমি চাইলেও আমার মা এর মতো হোমমেকার হতে পারবো না। আমার বাবা যতোক্ষণ অব্দি মাথা নেড়ে কথার উত্তর দেয়া যায়, ততোক্ষণ অব্দি কথা বলেন না। আমি যখন আজ কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, নিজের বাবার কথা, মা এর কথা মনে পড়ে, কী পরিশ্রমটাই না তারা করেছেন আমাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে, সবচেয়ে অসাধারণ কাজ করেছেন আমাদের দুবোনকে তারা শিক্ষিত আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য বানিয়েছেন। মানবিক আর কালচারডও। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ালে নিজেদের জন্মের গল্প শোনাটা আর ছেলেবেলার গল্প শোনা আর রাতে খাবার টেবিলে বাবা আম, আনার, আনারস কেটে খাওয়াতো, এসব ছাড়া তেমন কোনো সুখের স্মৃতি মনে পড়ে না।
আমি এখনো একজন বন্ধুকে মিস করি আমার বাবা-মা এর মাঝে, আমার বাচ্চা বিড়ালের মতো অলস গা এলিয়ে কোলে ঢুকতে ইচ্ছে করে, মা অতটুকু চায়নি বালিকা, চেয়েছিলো মা বকুক, বাবা দেখুক।