শাফিনেওয়াজ শিপু:
ধর্ম বিকৃত হতে হতে এখন কোন পর্যায়ে গিয়েছে, তা আমরা নিজেরাও কিন্তু জানি না। তবে এইটুকু বলতে পারবো, কিছু শ্রেণির মানুষ ও মৌলবাদীর কারণেই আজকে ধর্মের এই অবস্থা, যা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি প্রবাসে এসেও। সাধারণত এই দেশের মানুষ একমাত্র বড়দিনের সময় অনেক লম্বা একটা ছুটি পায়, ঠিক আমাদের দেশের ঈদের ছুটির মতো। যার কারণে সব ধর্মের মানুষই চায় এই ছুটিটা অনেক আনন্দের সাথে কাটাতে।
তাছাড়া আমরা সবাই জানি যে, লন্ডন এমন একটা শহর, যেখানে সব ধর্মের উপস্থিতি আছে। যেহেতু এটি খিস্ট্রান অধ্যুষিত দেশ, যার কারণে বড়দিনের সময়ই এতো বড় একটা ছুটি পাওয়া যায়, যা অন্যান্য উৎসবে পাওয়া যায় না। আর এই লম্বা ছুটির পর আবার সেই যান্ত্রিক জীবনে সবাইকে ফেরত যেতে হয়, সুতরাং একই কারণে আমিও পরিকল্পনা করেছিলাম আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে আনন্দের সাথে দিনগুলো পার করবো। কিন্তু সেই সৌভাগ্যটা আমার আর হয়ে উঠেনি।
খুব আগ্রহ নিয়ে বড়দিনে সকালে কল করেছিলাম এক আত্মীয়কে আজকের কী প্ল্যার, মানে কীভাবে সবাই একসাথে দেখা করবো, এমনিতে এই দিনটিতে এখনকার সব যানবাহন বন্ধ থাকে। যাই হোক তারপরও চিন্তা করলাম, ক্যাব ভাড়া করে দেখা করতে যাবো, কিন্তু তার আগে ফোনে যেসব কথা শুনালো, এরপরে যাওয়ার আগ্রহটা একেবারে কমে গেলো।
ওই আত্মীয়ের মতে, বড়দিন আমাদের উৎসব নয়, তাহলে কেন পালন করবো?? এগুলো পালন করা শিরক। ইসলামি শরীয়তে বলা আছে, এগুলো হারাম। যার কারণে তারা এসব পছন্দ করেন না। কিন্তু আমি যখন বললাম, “আমি তো বড়দিনকে উৎসব হিসেবে দেখি। আর তাছাড়া কোনো ধর্মে লেখা নাই যে উৎসব পালন করা হারাম।”
খুব অবাক হলাম আত্মীয়ের কথা শুনে। তবে এইখানে সব বাঙ্গালীরা আবার এক রকম না। অনেকেই আছেন খুব আনন্দ ও উল্লাসের সাথে দিনটি পার করে। আবার কেউ কেউ আছেন ধর্মের গোঁড়ামির কারণে এই উৎসবের আনন্দ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। আগে আমার ধারণা ছিলো শুধুমাত্র আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে এতো সমস্যা ও বির্তক, কিন্তু এখন তো দেখি, এইখানেও মানে এইদেশেও কিন্তু কোন অংশে কম না, যা আমাদের বাঙালীদের মধ্যে দেখা যায়। খাদ্যে ও কাজে-কর্মে আমরা হালাল বা হারাম শব্দটি ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু তাই বলে উৎসবকেও এর অর্ন্তভুক্ত করবো?
আমরা নিজেরাও ঠিকমতো জানি না কেন প্রত্যেকটি উৎসবকে হালাল ও হারামের বেড়াজালে বন্দী করে রাখছি। এমনকি বাল্যকাল থেকে যে ধর্মের শিক্ষা নিয়ে মানুষ হয়েছি, এইখানে এসে তার একেবারে ভিন্ন রুপ দেখতে পাচ্ছি, যা কিনা গোঁড়ামির চরম। এমনকি এটাও শুনতে হলো, “থার্টি ফার্স্ট নাইট” পালন করা নাকি মুসলমানদের জন্য হারাম এবং থার্টি ফার্স্ট নাইট যারা পালন করে, তারা কেউ ভদ্র পরিবারের নয়। শুধু তাই নয়, সেই সাথে এই রাতটি উদযাপনের মাধ্যমে আমরা সবাই নাকি গুনাহর ভাগিদার হচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা আমাদের আনন্দ ও অনুভূতিগুলোকে কবর দিচ্ছি এই এক ধর্মের কারণে।
দেশে না হয় মানুষ অনেক ধর্মীয় কুসংস্কারের মধ্যে বসবাস করছে, কিন্তু এই সভ্য দেশে এসেও যদি এখনো মানুষ ধর্মীয় বেড়াজালের মধ্যে নিজেকে আটকিয়ে রাখে, তাহলে আর কিছু বলার নেই। তবে এই থেকেই বুঝা যায়, শিশুকাল থেকে আমাদের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে কে পার্থক্য সৃষ্টি করছে?
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, সবকিছুতে আমরা ধর্মকে টানি এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করি এবং সেইসাথে প্রত্যেকটি উৎসবকেও আমরা বিভক্ত করে ফেলি। শুধু উৎসব নয়, এমনকি আমাদের ব্যবহারেও কিন্তু ভিন্নতা দেখা যায় ধর্মের কারণে, যা প্রবাসে এসেও দেখতে পাচ্ছি। এই দেশে ইংরেজরা যেমন বৈষম্য সৃষ্টি করে বর্ণের দিক দিয়ে, ঠিক তেমনি আমরাও কিন্তু বৈষম্য সৃষ্টি করি ধর্মের দিক দিয়ে।