হেলেনা অাফরোজ:
“ইমোশোনাল লেবার” হলো সেরকমই একটা “অানপেইড জব” যেটা পুরুষরা বেশিরভাগ সময়ই বোঝে না। ব্যাপারটা নিয়ে সেদিন এখানে একজন বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। ওর ভাষ্যমতে, মাদার’স ডে’তে অামি একটা গিফট চেয়েছিলাম অামার হাজবেন্ড এর কাছে, একটা হাউজ ক্লিনিং সার্ভিস। গিফট হিসাবে এটা অাসলে খুব বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু অামি অাসলে যেটা চাচ্ছিলাম, তা হলো একবারের জন্য এই হাউজহোল্ড অফিস ওয়ার্ক থেকে মুক্তি।
যেমন অামাকে বিভিন্ন ক্লিনিং সার্ভিস এ কল করতে হবে না। দাম কোয়ালিটি সব কম্পেয়ার করে একটাকে বাছাই করতে হবে না। যে সত্যিকার গিফ্টটা অামি চাচ্ছিলাম তা হলো এই প্রত্যেকটা ছোট ছোট খুঁটিনাটি ইমোশোনাল পেইন থেকে মুক্তি। অার তারপর একটা ঝকঝকে পরিস্কার বাড়ি হবে সত্যিই বোনাস।
যদিও অামার হাজবেন্ড ওয়েট করছিল কোনভাবে যদি অামার মন চেঞ্জ হয়। অার অামি হাউজ ক্লিনিং এর পরিবর্তে এমন কোন গিফ্ট চাই যেটা সে অনলাইন এ অর্ডার করে, বা দোকান থেকে সহজেই কিনে ফেলতে পারবে।
তবে অামি সত্যিই চাচ্ছিলাম, অামার হাজবেন্ড হয়তো তার বন্ধুদের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ চাইবে। অথবা তিন চারটা ক্লিনিং সার্ভিস এ ফোন করে তাদের দাম এবং কোয়ালিটির মধ্যে কম্পেয়ার করবে। এবং ঠিক ওইভাবে পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করবে যেভাবে অামাকে করতে হয়। যতটা মেন্টাল এনার্জি অামার লস হয়, ততটা তারও হবে।
“ইমোশোনাল লেবার” এর কনসেপ্টটা যদি অামরা একটু ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটা বোধহয় এরকম হতে পারে। একজন মহিলা, একজন ওয়াইফ, বা একজন মা তাকে অামরা বিভিন্ন নামে ডাকতে পারি। যেমন হাউজ ওয়াইফ, হোম মেকার, বা হোম ম্যানেজার। অার একটা বাড়ির হোম ম্যানেজার থাকার অর্থ হলো অসংখ্য থ্যাংকসলেস ওয়ার্ক। এমন সব কাজ পুরুষদেরকে বা স্বামীকে বলে বলে করানো, যা তার স্বাভাবিকভাবেই জানার বা করার কথা ছিল। অার এটা সত্যিই বিরক্তিকর বা ক্লান্তিকর। অার এই ব্যাপারগুলো বোঝাতে বা ম্যানেজ করতে দরকার হয় যথেষ্ট পরিমাণ সেল্ফ-কনট্রোল।
অামাদের সমাজে মেয়েদের তাদের অার্লি এইজ থেকেই শেখানো হয় যে, এগুলো ব্যাপারে কথা বললেই সংসারে শান্তি নষ্ট হবে বা পার্টনার হতাশ হবে। সুতরাং নীরবতাই শান্তির চাবিকাঠি। এটা অামরা সকলেই জানি যে বায়োলজি শুধুমাত্র অাপনার জেন্ডার নির্ধারণ করে। কিন্তুু জেন্ডার বা নারী পুরুষ ভেদে অাপনার যে দায়িত্ব সেটা সম্পূর্ণই সমাজ ঠিক করে দেয়। তেমনিভাবে এটাও অামাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখান থেকে অামরা ভাবতে শিখেছি যে, মহিলারা স্বাভাবিকভাবে বা প্রকৃতিগতভাবে পুরুষদের তুলনায় ভালভাবে ইমোশনকে বুঝতে, প্রকাশ করতে, এবং ম্যানেজ করতে পারে।
যেহেতু সমাজবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান কেউ এই কথাটা এভিডেন্সসহ স্বীকার করছে না, সুতরাং এটা অবশ্যই অামাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অার যেহেতু মহিলা পুরুষের মধ্যের এই পার্থক্যটা প্রকৃতিগতভাবে বা জন্মগতভাবে তৈরি হয়নি বরং সমাজ এটা নির্ধারন করে দিয়েছে। যে শুধুমাই মহিলারাই ইমোশনাল ব্যাপারগুলোর জন্য রেসপনসিবল। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই পুরুষরা একটা “পাশ” পেয়ে যাচ্ছে যে এই ব্যাপারগুলো তাদের না ভাবলেও চলবে।
অামরা বেশিরভাগ সময় ইমোরশানাল লেবার কে মিক্স করে ফেলি প্রবলেম সলভিং এর সাথে। যেহেতু অামাদের মোটামুটি মাইন্ড সেট যে, পুরুষরা হচ্ছে প্রবেলেম সলভার কারণ মহিলারা খুব বেশি ইমোশোনাল। তবে একটু ভালভাবে চিন্তা করলে বোধহয় অামরা বুঝতে পারবো বাড়ি এবং অফিস দুই জায়গাতেই সমানভাবে কারা বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান করছে ।
অামি নিশ্চিত অাপনি যদি হোম ম্যানেজার হোন অাপনার স্বামী এবং সন্তানদের জন্য, তবে অাপনি জানেন উত্তরটা।ইমোশোনাল লেবার সত্যিই খুব হতাশাজনক, কারণ কেউ অাপনার এই কাজগুলো নোটিশ করবে না। যতখ্খন না অাপনি এই কাজগুলো করা বন্ধ করবেন। অার এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের হয়ত কোন রাস্তাই নেই। এর সবচেয়ে বিরক্তিকর দিকটা হচ্ছে এটা মেন্টালি সবসময় অাপনাকে একটা রিমাইন্ডার দিতে থাকবে।
অাপনি যখন অাপনার পার্টনারকে কোন কিছুর জন্য বার বার মনে করাতে যাবেন সে স্বাভাবিকভাবেই খুব বিরক্ত হবে। কিন্তু যে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক তা হলো, এই একই ব্যাপার যখন অাপনার সাথে ঘটছে মানে এই যে, সব ইমোশোনাল এবং মেন্টাল এনার্জি অাপনি ব্যয় করছেন পরিবারের জন্য, সেটা সে নোটিশই করতে পারছে না।
অার দিনের পর দিন চলতে থাকা এই ইমব্যালেন্স ইমোশোনাল ওয়ার্কগুলোই পরিণত হচ্ছে ইমোশোনাল লেবারে। অার এই ধরনের অস্বাভাবিক মেন্টাল লোডগুলো সবসময় মহিলাদেরকে জেন্ডার ইনইকুয়ালিটির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে অনেক পুরুষ অাছেন যারা ফেমিনিস্ট পারসন। যারা তাদের ওয়াইফদেরকে বিভিন্নভাবে এপ্রিশিয়েট করে। একইসাথে সংসারে কাজেও সাহায্য করতে চায়, যেমন খাবারের পর ডিশ ক্লিন করা, মাঝে মাঝে ডিনার রেডি করা, ওয়াইফ বিজি থাকলে বাচ্চাদের দেখাশোনা, এমনকি বিছানাটা রেডি করা।
অার এই পুরো ব্যাপারটাতে ওয়াইফকে যেটা করতে হবে, তা হল হাজবেন্ডকে বলতে হবে বা হেল্প চাইতে হবে। অার প্রব্লেমটা বোধহয় সেখানেই। কারন ওয়াইফ রা কোন মাইক্রো ম্যানেজড হাউজওয়ার্কার চাচ্ছে না। যে বলামাত্রই সংসারের যে কোনো কাজ করতে চাইবে বা করতে পারবে। বরং একজন পার্টনার চাচ্ছে উইথ ইকুয়াল ইনিশিয়েটিভ।
অার এসব ঘটনা যখন কোন পরিবারের জন্য অতি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন এর খারাপ প্রভাবগুলো সবচেয়ে বেশি পড়ছে অাপনার সন্তানের উপর। বাচ্চারা যেহেতু পিতামাতার ফুটস্টেপ ফলো করে সুতরাং পরিবারে কার কি রোল এবং সেটা কে কিভাবে পালন করছে সেটা সে অাপনাকে দেখে শিখছে। একইসাথে অামরা তাদের কে জেন্ডার ইমব্যালেন্সটাও শিখাচ্ছি।
গবেষণা বলছে বাচ্চারা তিন বছর বয়স থেকেই জেন্ডার রোলগুলো বুঝতে শেখে। অার এই সময়টা তারা পিতামাতার সাথেই বেশিসময় কাটায়। সুতরাং অামরা যদি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইমোশোনাল লেবার এর এক্সপেকটেশন গুলো পরিবর্তন করতে চাই, সেটা শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।
পিতামাতাকে নিশ্চিত করতে হবে কিভাবে তারা ইমোশোনাল লেবারগুলো সমানভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারে। বাচ্চারা যখন দেখবে কিভাবে তারা সংসারের দৈনন্দিন কাজগুলো নিজেদের মধ্যে শেয়ার করছে যেটা একজনের উপর বোঝা হচ্ছে না। এই শিখ্খা তারা পরবর্তীতে নিজেদের জীবনে কাজে লাগাবে।
যদিও এটা সত্যি যে একটা সংসারের ইমোশোনাল লেবারগুলোকে সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করা বা সমানভাবে দুজনের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার ব্যাপার টা খুব সহজ হবে না। একইভাবে একজন মহিলা যেহেতু একরকম দিনের পর দিন খুব স্বাভাবিক নিয়মে ইমোশোনাল লেবার গুলোকে প্রাকটিস করে অাসছে, সুতরাং সে যে এই ব্যাপারটা কোন পুরুষের চাইকে খানিকটা ভাল বুঝবে সেটাই স্বাভাবিক।
ইভেন অামাকে এটাও স্বীকার করতে হবে যে কিছু কিছু ইমোশোনাল লেবার অামি করতে ভালবাসি অামার হাজবেন্ড এর তুলনায়। সেটা হতে পারে পরিবারের জন্য খাবারের প্লানিং বা কোথাও ঘুরতে যাবার প্লানিং।
কিন্তুু অামার মনে হয় অামরা নিজেদের কে সৌভাগ্যবান তখনই বলতে পারবো, যখন এই সব কাজ গুলো কেই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিবো। এবং অামাদের সন্তানদের কেও একইভাবে প্রস্তুত করতে পারবো।
অামাদের ছেলে সন্তানদের শিখাতে পারবো কিভাবে নিজের সবটুকু দায়িত্ব বা ভার নিজেকে বহন করতে হয়। একইভাবে মেয়ে সন্তানদের শিখাতে পারবো অন্যদের ভার বা বোঝা নিজের কাঁধে বহন না করতে।