অনুপম মাহমুদ:
রাজধানীর বাড্ডায় শিশু তানহাকে হত্যাকারী শিপন একজন দিনমজুর। এর আগে একটি ডাকাতি মামলায় পাঁচ বছর জেল খেটে বেরিয়েছে এক বছর হলো। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে অপরাধী তার সাজা ভোগ করে সভ্য সমাজে ফিরে আসবে, এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
জেলখানাকে বলা হয় Correctional Home, কিন্তু এই বেচারার মনের কালিমা দূর হয়নি মোটেই। মাত্র পৌণে চার বছরের তানহা তার প্রতিবেশী পরিবারের একমাত্র সন্তান। চকোলেটের লোভ দেখিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যায় সে। পাশবিক নির্যাতনের সময় চিৎকার করছিলো বলে গলা চেপে ধরে… কখন যে মরে গেছে, টেরই পায়নি। হুঁশ ফিরতেই বাঁচার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে পাষণ্ড জানোয়ার। কমোডে তানহার মাথা ঢুকিয়ে ফেলে আসে টয়লেটে, আর রক্তাক্ত জামা কাপড় ছেড়ে ভালো মানুষের মতো লুকিয়ে রইলো সমব্যাথীদের ভীড়ে…।
গোটা দেশ উত্তাল এখন তুফান ঝড়ে, ঘটনা বগুড়ায়। কিশোরী একটি মেয়ে কেবল মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু জিপিএ-৫ না পাওয়াতে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ সীমিত আশঙ্কায় মেয়েটি ছিলো বিচলিত। অন্যদিকে এলাকার বখাটে তুফান সঙ্গী সাথী নিয়ে মেয়েটিকে উত্যক্ত করতো প্রায়শই। খোঁজ খবর কী জানতে চাইতো, কিছু লাগলে জানাতে বলতো, ইত্যাদি ইত্যাদি… হতাশ মেয়েটি বললো, শহরের ভালো কলেজটিতে পারলে ভর্তি করিয়ে দেয় যেন! এই সুযোগের পুরো ফায়দা নিয়েছে তুফান। মেয়েটির বাসায় ক্যাডার পাঠিয়ে তুলে এনে জোরপূর্বক… তারপর বাকিটা সবাই জানেন।
এই তুফানের অতীত ইতিহাস পরিষ্কার নয়। মাদক, হত্যা মামলায় জেল খেটেছে। ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিকদের শহর কমিটির প্রধান সে। স্ত্রীর বড় বোন পৌরসভার মহিলা কাউন্সিলর। তুফানের স্ত্রী আশা তার বোন ও মাকে নিয়ে উল্টো সেই নির্যাতনের শিকার মেয়ে ও মাকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, উপর্যুপরি তাদের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে। মেয়েটির চুলই নাকি তার স্বামীকে পাগল করেছে, এমনই ছিল আশার অভিযোগ, সুতরাং দাও চুল কেটে। এ যেন মগের মুল্লুক! ক্ষমতার দম্ভে সবাই অন্ধ হয়ে উঠেছে।
আমাদের স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট প্রখর নয় অথবা এতো এতো ঘটনা মনে রাখাও মুশকিল। তনু নামে একটা মেয়ে ছিলো, যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তো। দরিদ্র বাবার এই মেয়ে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগাতো, অল্প বিস্তর গানও করতো। হিজাব পরলেও নাটক করতো মঞ্চে। অনেকেই বলে থাকেন যে, মেয়েদের পোশাক-আশাকের জন্য দেশে ধর্ষণের মতো অনাচার বেড়ে গিয়েছে! কিন্তু এই হিজাব পরা মেয়েটি রক্ষা পায়নি দেশের সবচেয়ে নিরাপদ আবাসেও। এই ঘটনায় সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়েছিলো, কিন্তু ময়না তদন্ত ও মামলার অগ্রগতি এখন হিমঘরে।
আজ ০২ আগস্ট ২০১৭ এর দৈনিক পত্র পত্রিকায় প্রকাশ; গোপালঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে প্রেম নিবেদন করেছিলো বখাটে মামুন, সাড়া না পেয়ে বিয়ের প্রস্তাব! মেয়েটির কি বিয়ের বয়েস হয়েছিলো? তাতে কি, জোর করে তুলে নিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ… ধর্ষক যথারীতি পলাতক। হায়রে মামুন, এই ছিলো তোর মনে? এই তোর ভালোবাসার নমুনা? ভালোবাসার মানুষটিকে “ভালোবাসা” বোঝার সময়টুকুও দিবি না?
পুরনো ঢাকায় বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ধর্ষণ করতো তারই ফুফা! নিয়মিত করে গেছে এই অপকর্ম, কারণ মেয়েটি যে কথা বলতে পারে না। যখন মেয়েটি সন্তান-সম্ভবা হয়ে গেলে তখনই প্রকাশ পায়। গতকাল এই নিউজটি দেখছিলাম একটি বেসরকারি টিভিতে, মেয়েটির ভাই ও বাবা বলছিলো তাদের নাকি সেই লম্পট পাঁচ লাখ টাকা দিতে চায় মিটমাট করার জন্য! টাকায় কী না হয় বস!
বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দিয়েও অভিযুক্তরা তা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছে আর নানা বাহানায় সময় ক্ষেপনের পথ বেছে নিচ্ছেন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলা অনুচিত, তবে সমাজে এই প্রবণতা থামলো কই? এর কিছুদিনের মাথায় আবারো দেখলাম এই বনানীতেই ন্যাম ভবনে একজন ব্যবসায়ীর বখাটে ছেলে একই কাণ্ড আবারো ঘটিয়েছে। এই নরক যাত্রার শেষ কোথায়?
দিনাজপুরের ইয়াসমিনের কথা মনে আছে আমাদের? গোটা দেশ অচল হয়ে গিয়েছিলো, ন্যায় বিচারের জন্য আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসেছিলো দিনাজপুরের গণমানুষ, সেই সাথে উত্তাল সারা বাংলাদেশ। ২৪ আগস্ট ১৯৯৫ সালের কথা, সেদিন কিশোরী ইয়াসমিনকে ‘পতিতা’ বলেও সম্বোধন করেছিলো পুলিশ! একজন পতিতাকেও কি পুলিশ চাইলে ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে পারে? এই অধিকার তাকে কেউ দিয়েছিলো? ঢাকায় কাজ করতো মেয়েটি, মায়ের সাথে দেখা করার জন্য দিনাজপুরে ফিরছিলো… ক্ষোভে উন্মত্ত জনতা থানা ঘেরাও করে প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে, পুলিশ চালিয়েছিলো গুলি, সাতটি তাজা প্রাণের বিনিময়ে শান্ত হয়েছিলো তখন দিনাজপুর, আর এর মধ্য দিয়ে চওড়া হয়েছিলো ন্যায় বিচারের পথ।
বগুড়ায় তুফান কাণ্ডে বিপর্যস্ত মেয়েটি একটি পত্রিকার প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, “আমি নিজে কতবার রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, মানব বন্ধন করেছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। আজ আমিই শিকার হলাম এমনই একটা ঘটনার। আর আমার জন্য অন্য কেউ রাস্তায় নেমেছে আজ। আমি ভাবিনি কোনদিন এমন হবে…” আমরা এমনই এক অনিশ্চয়তায় আছি। আমরা জানি না পরবর্তী ভিকটিম কে? আমি না আপনি।
ছোটবেলায় বুবু (দাদী) বাসায় মুরগী রান্না হলে কলিজা খেতে দিতেন না, ছেলেদের নাকি ওটা খেতে নেই, তাহলে আমার কলিজা হতো মুরগীর মতো, আমি তো পুরুষ! বাসায় মুরগী রান্না হলে রান আর মাছের বেলায় মাথাটা আমার পাতেই উঠতো, একটা মাত্র ছেলে বলে কথা…শুনেছি সোনার আংটি বাঁকা হলেও আমরা ছেলেরা সোনা-ই।
দাদাভাই মারা গেছেন ৩২ বছর আর বাবা ১৬ বছর, পরিবারে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষ নেই। বাসায় অসুস্থ্য বুবু, স্ত্রী, দুই কন্যা, বুবুকে দেখাশোনা করার জন্য পরিচারিকা… আর আমিই শুধু পুরুষ! অফিসে কিংবা অফিসের গাড়িতে সহযাত্রী নারী সহকর্মী, বাজারে, দোকানে এমনকি অনলাইনে নারী বন্ধু, আত্মীয় পরিজন… সর্বত্রই এই পুরুষ পরিচয় আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কারো দিকে তাকাতেও ভয় হয়, লজ্জা তাড়া করে, শঙ্কিত হই, আমাকে ধর্ষক বা নিপীড়ক ভাবছে নাতো? আমাকে সন্দেহ করছে কি? আমি নিজেও তো একটা পটেনশিয়াল রেপিষ্ট…
উফ! আর নিতে পারছি না। অনেক হয়েছে পুরুষ, এবার একটু মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই…