বিপ্রতীপ

অনুভা হরি সরকার:

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ পড়ে গেল পাশের প্রতিবেশী মহিলার চোখে।
একমুখ হাসি। 
বললেন, “একদিনও তো এলেন না আমার ঘরে। আজ আসুন, কথা বলি আপনার সাথে।”
আমি অগত্যা গেলাম তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটে। মহিলা একাই থাকেন। বারান্দায় সুন্দর বাগান। সবুজে শ্যামলে অপরূপ।
ঘরে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল।

কী চমৎকার পরিপাটি সাজানো গুছানো কক্ষ!
টবে দৃষ্টি নন্দন লতানো পাতাবাহার, এক কোণে ঝকঝকে বনসাই।
দেয়ালে আমাদের দেশীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। হাতের সূক্ষ্ম সূচী শিল্পের টেবিল কভার। ছোট্ট শোকেসে সুন্দর মূর্তি। পোড়া মাটির, পেতলের স্মারক চিহ্ন। 
যত্নে গুছিয়ে রাখা বই এর সারি। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের বই। খ্যাতনামা লেখক কবিদের লেখা।
দেখেই মনটা ভরে উঠলো প্রসন্নতায়। বুঝে গেলাম তার রুচি মার্জিত মনের খোঁজ।

কথা হলো, গল্প। অনেকদিন পর মনের জানালাটা খুলে গেল। দুজনেরই। শুনলাম তাঁর একক জীবনের কাহিনী, ঘর ভাঙার করুণ গল্প।—–

আমার ভারি ভাল লাগলো তাঁকে। সমবেদনায় ভরে গেল অন্তর।

কী আন্তরিক, খোলামেলা অভিব্যক্তি কথায়, চাউনিতে! চোখ বুঝি মনের কথা বলে!

সুন্দর নকশা করা পেয়ালায় গাঢ় সোনালী রঙের ধোঁয়া ওঠা চা। সোনালি বর্ডারের ফুল পাতার কারুকার্যময় প্লেটে কিছু কাজু বাদাম, পাঁপড়ভাজা আর ডালমুট।
এতো মানা করলাম, শুনলেন না। খেতেই হলো। সেই সঙ্গে অতীত দিনের গল্প গাঁথা।

একসময় কথা, গল্প শেষ হলো। অনেকদিন এরকম কথা হয়নি কারো সাথে। এত অন্তরঙ্গতায়।
বললাম,” আমাদের বাসায় আসুন। নাতনির জন্যে ঘরের অবস্থা নিতান্তই নাজুক। সব অগোছালো, অসুন্দর। দেয়াল জোড়া আঁকিবুকি। তবু যাবেন। কথা হবে।”—–

হাসলেন ভদ্রমহিলা। বললেন,” সারাদিন ওই তো কাজ।একবার গুছিয়ে রাখলেই হল। কেউ নেই তছনছ্ করে, অগোছালো করে।”
একটু থেমে আবার বললেন, 
“নষ্ট করবার, ভেঙেচুরে একাকার করবার একজন কেউ যদি ঘরে থাকতো আমার।”

আমি তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই তিনি ছলছল চোখে আবার বললেন,” একটা ঝগড়া করবার লোকও যদি আমার ঘরে থাকতো দিদি!”——

আমি আর তাঁর মুখের দিকে তাকালামনা। অনেকটা যেন পালিয়েই চলে এলাম নিজের ঘরে।
আমার চোখও যে ভিজে উঠেছে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.