শাশ্বতী বিপ্লব:
দ্বিতীয় পর্ব যখন লিখতে বসেছি তখন দেশ ভেসে যাচ্ছে তুমুল বর্ষণে। বৃষ্টি দাপট ভিজিয়ে দিচ্ছে সমতল পাহাড় সব। তীব্র গরমের পর এই বৃষ্টি অনেকের কাছে রোমান্টিক মনে হলেও, গৃহহীন মানুষের কাছে সেই রোমান্টিসিজম ধরা দেয় না। সমতলে বা পাহাড়ে; বাস্তুহারা বাঙ্গালী কিংবা আদিবাসীর জীবনে এমন টানা বৃষ্টি কেবল বাড়তি ভোগান্তিই যোগ করে। এর মাঝে তিন পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক মানুষ। লংগদুর গৃহহীন মানুষগুলো কী করছে কে জানে!
যাক, ইতিহাসে ফিরে আসি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে জমে আছে রাজনৈতিক আগ্রাসন আর জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার আস্ফালন। পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী বলা বা না বলা নিয়েও আছে আরেক রাজনীতি। তথ্য প্রমাণ দিয়ে অনেকেই প্রমাণ করে দিতে পারবেন, ষোল শতকের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা যাযাবর জীবনযাপন করতো এবং জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মোটামুটি ষোল শতকের শুরু থেকে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
কিন্তু এই প্রমাণে কী যায় আসে! প্রায় ৫০০ বছর ধরে বসবাস করার পরও কেন সেই মাটি তাদের নয়! যে মাটিতে তাদের পূর্বপুরুষের বাস করেছে! যদি বাস নাও করতো, তাতেই বা কী! তাতে পাহাড়ের মানুষগুলোর মানুষ পরিচয়টা তো মিথ্যে হয়ে যায় না। আদিবাসী হোক বা না হোক, কোনো লেবেল লাগিয়েই তাদের উপর যে শোষণ, নির্যাতন চলে আসছে, সেটা জায়েজ করা যায় না।
এ বিষয়ে অনেকেই লিখেছেন। আমি শুধু ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাই বলার চেষ্টা করবো, যতোটুকু জেনেছি। মুঘলরা ১৬৬৬ সাল থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত, ব্রিটিশরা ১৭৬০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেছে। ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অংশে পরিণত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে, বাংলা ভূখণ্ডের চেয়ে বার্মা/মিয়ানমার ও ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়লেও নৃগোষ্ঠীর নেতারা সেটা কখনোই চায়নি। মূলতঃ সেই সময় থেকেই সংঘাতের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে থাকে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পুরো পার্বত্য অঞ্চলকে প্রধানত তিনভাগে ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। এর মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানকে, আরাকান পার্বত্য অঞ্চল বার্মাকে (মিয়ানমারকে) এবং ত্রিপুরা ও লুসাই (মিজোরাম) পার্বত্য অঞ্চল ভারতকে দেয়া হয়।
পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান শাসন করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনভার থেকে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এইরকম উদ্ভট প্রসাশনিক ব্যবস্থার পেছনে ঐতিহাসিক কারণও ছিলো। ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় পাঞ্জাবের ফিরোজপুর পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটা ভারতের ভাগে থেকে যায়, কারণ ফিরোজপুরে অধিকাংশ মানুষই ছিলো শিখ সম্প্রদায়ের।
পাকিস্তানের এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের ভাগে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় (সূত্র: Wolfgang Mey, 1984)। তৎকালীন ভারতীয় নেতারা, বিশেষ করে, ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে রাখার পক্ষপাতি ছিলো এবং নৃগোষ্ঠীর নেতাদের সেটাতে সমর্থনও ছিলো। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
(চলবে)
পর্ব – ১ এর লিংক: https://womenchapter.com/views/21068