নারীর স্বাধীনতাই যখন বড় হুমকি ইসলামী দলগুলোর কাছে!

আব্দুল্লাহ আল সাকিব:

গত ১৯ এপ্রিল ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করে — যেখানে নারীর সমতা, অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ৪০০টির বেশি প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। রিপোর্টটি প্রকাশের পর থেকেই জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ইসলামপন্থী দলগুলো তীব্র প্রতিবাদ করছে।

কী কী বলা হয়েছে এই রিপোর্টে? মূল পয়েন্টগুলি একটু দেখা যাক:

১. নারী-পুরুষের সমান সম্পত্তির অধিকার: বর্তমানে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে একজন ছেলে দুই অংশ পায়, আর মেয়ে পায় এক অংশ। কমিশন বলেছে – এটা বৈষম্যমূলক। তাই, মেয়েরা যেন পুরুষদের মতোই সমান ভাগে সম্পত্তি পায়, সেই অনুযায়ী উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে।

২. অভিন্ন পারিবারিক আইন (Uniform Civil Code): বাংলাদেশে ধর্ম অনুযায়ী বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি আলাদা নিয়মে চলে। কমিশন বলেছে – ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়।

৩. বৈবাহিক ধর্ষণকে (Marital Rape) অপরাধ হিসেবে গণ্য করা: বর্তমানে স্বামীর দ্বারা স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ধরা হয় না। কমিশনের মতে, এটি নারীর দেহের ওপর তার অধিকার লঙ্ঘন। তাই, স্বামীর জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককেও আইনগতভাবে ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

৪. নারীর বৈবাহিক ও পারিবারিক অধিকারে সমতা: বাংলাদেশ নারী বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW)-এ স্বাক্ষর করলেও কিছু ধারা এখনও কার্যকর নয়। এসব ধারা মূলত ব্যক্তিগত আইন সংস্কার এবং বিয়ে-তালাকের ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। কমিশন বলেছে – সকল সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সনদের সব ধারা বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর হয়।

৫. যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু করা: স্কুল ও কলেজে বাধ্যতামূলক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে কিশোর-কিশোরীরা সম্মতি, নিরাপদ সম্পর্ক, পিরিয়ড, গর্ভধারণ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন হবে এবং বাল্যবিবাহ বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমবে।

৬. যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি: কমিশন বলেছে – যারা পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত, তাদের অপরাধী হিসেবে নয়, বরং শ্রমজীবী নারী হিসেবে অধিকার দিতে হবে। এতে করে তারা সুরক্ষা পাবে, শোষণের শিকার হবে না এবং স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তা পাবে।

৭. রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো: বর্তমানে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনগুলোতে সরাসরি ভোট হয় না। কমিশন সুপারিশ করেছে – প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ এবং একটি সংরক্ষিত নারী আসন রাখা হোক, যাতে নারীরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুবিধার্থে ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং পিতৃসহযোগিতার জন্য ২ সপ্তাহ পিতৃত্বকালীন ছুটি বিধিবদ্ধ করার সুপারিশ রয়েছে । বিভিন্ন অফিসে শিশুসদন (ডে-কেয়ার সেন্টার) স্থাপন, কর্মজীবী নারীদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ ইত্যাদিও প্রস্তাবিত হয়েছে।

কেন ইসলামি দলগুলো এমনভাবে প্রতিবাদ করছে? তাদের বক্তব্য বা আপত্তিগুলি হচ্ছে:

১. সমান সম্পত্তির অধিকার নিয়ে আপত্তি: জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো বলছে – কোরআনে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পায়, এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। তাদের মতে, “এটা কুরআনের বিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্বের ওপর সুপরিকল্পিত আঘাত”। তাই এটি পরিবর্তন করা মানেই ইসলামবিরোধী কাজ করা।

২. অভিন্ন পারিবারিক আইন বিষয়ক আপত্তি: তাদের মতে, সব ধর্মের জন্য এক আইন চালু করা মানে মুসলিম পারিবারিক শরিয়াহ বাতিল করা। এতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হবে এবং মুসলিম সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। জামায়াত এবং হেফাজতে ইসলামের মতে “এই অভিন্ন আইন চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগটি বাংলাদেশের ধর্মীয় ভারসাম্য ও পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ”।

৩. বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকৃতি নিয়ে আপত্তি: ইসলামি নেতারা বলছেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে সম্মতি বা ধর্ষণের প্রশ্ন আসে না। তাই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ইসলামি পারিবারিক কাঠামোর বিরুদ্ধে।

৪. CEDAW বাস্তবায়নে আপত্তি: কমিশন CEDAW-এর সব ধারা বাস্তবায়নের কথা বললেও ইসলামপন্থীরা বলছে – সনদের বেশ কিছু শর্ত ইসলামী পরিবার কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক, তাই তা পুরোপুরি গ্রহণ করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বিয়ে (নিকাহ্) ও অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত ইসলামী নিয়মকানুনের কথা উল্লেখ করেছে জামায়াতে ইসলাম। ইসলামি শরিয়তে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা ও অধিকার বিষয়ক যে ভিন্নতা আছে (যেমন পুরুষ অভিভাবক বা পরিবারপ্রধান হওয়া, মোহরানা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব ইত্যাদি), সেগুলো CEDAW অনুযায়ী পুরোপুরি সমতাভিত্তিক করলে ধর্মীয় বিধানের সাথে সংঘাত ঘটবে বলে তাদের মত। জামাতের নেতারা নারী-পুরুষের পারিবারিক ভূমিকা “এক ও অভিন্ন” করে দেওয়ার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

৫. যৌন শিক্ষা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে উদ্যোগ ‘অশ্লীল’: স্কুলে যৌন ও প্রজনন শিক্ষা চালু করার প্রস্তাবকে ইসলামি দলগুলো ‘অনৈতিক ও অশ্লীল’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলছে, এতে সমাজে পশ্চিমা মূল্যবোধ ছড়াবে।

৬. যৌনকর্মকে বৈধতা দেওয়া নিয়ে আপত্তি: যৌনকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবকে জামায়াত ও হেফাজত ‘ব্যভিচারকে বৈধতা দেওয়া’ হিসেবে দেখছে। তারা বলছে – এটি সমাজকে নৈতিকভাবে ধ্বংস করবে।

এই রিপোর্ট নারী অধিকার ও সমতার দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও ইসলামি দলগুলোর চোখে এটি শরিয়াহ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এই সংস্কার বাস্তবায়িত হলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অস্থিরতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এই রিপোর্ট পড়ে তাদের এহেন উত্তেজনা দেখে বোঝা যায়, এই দলগুলোর চোখে নারীর নিরাপত্তা নয় — বরং ‘নারীর স্বাধীনতা’ই সবচেয়ে বড় হুমকি। তারা চান না মেয়েরা নিজের শরীর, সম্পত্তি বা সিদ্ধান্তের উপর অধিকার পাক।

 

তথ্যসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, বিডিনিউজ২৪.কম, ঢাকা ট্রিবিউন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, নিউ এজ, শেয়ার-নেট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (BSS)।

শেয়ার করুন: