প্রভাত নাজমী:
তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সবসময়ই একটি আলোচিত বিষয়। বিশেষ করে দেশীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তারকা কিংবা খ্যাতিমান ব্যক্তিদের বিবাহিত জীবনে বিচ্ছেদ ঘটলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং বিদ্রূপের ঝড় বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এক্ষেত্রে উক্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পক্ষে-বিপক্ষে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানাবিধ যুক্তি-কুযুক্তি পরিলক্ষিত হয়।
সাবেক তারকা দম্পতি তাহসান-মিথিলার বিবাহবিচ্ছেদ এ জাতির অনেক আবেগপ্রবণ সন্তান আজও মেনে নিতে পারেনি। বিখ্যাত ধনকুবের বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসের সাম্প্রতিক বিবাহবিচ্ছেদ মানতেও এ জাতির যেন ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে! তারকাদের দাম্পত্য জীবনে সুখ নাই, পশ্চিমাদের দাম্পত্য জীবনে শান্তি নাই— এ ধরনের বায়বীয় কথাবার্তা বলে বঙ্গীয় রক্ষণশীল সমাজ যে বিনোদন ও সান্ত্বনা পায়, তাতে সাময়িক আত্মতৃপ্তি থাকলেও দীর্ঘমেয়াদী আনন্দ নাই।
ইদানিংকালে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, অনেক শিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মানুষ তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য গণহারে নারীদের দোষারোপ করছেন। তারা এক্ষেত্রে নারীশিক্ষা এবং নারীদের চাকুরিকে বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন। নারীরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করলে সাংসারিক হয় না, বিবাহিত জীবনে মনযোগী হয় না, আদর্শ স্ত্রী হিসেবে স্বামীভক্ত হয় না— এমন হাস্যকর অভিযোগ-অনুযোগ এদেশে এখন বহুল প্রচলিত এবং ব্যাপকহারে প্রচার হচ্ছে। অথচ গবেষণা ও পরিসংখ্যান আমাদের দেশের বিবাহিত নারীদের জীবনের উপর দিচ্ছে উদ্বেগজনক তথ্য।
মানবাধিকার সংস্থা- অধিকার এর তথ্যানুসারে, আমাদের দেশে ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬০৫৭ জন বিবাহিত নারী যৌতুক সম্পর্কিত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে ৩৪১০ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে এবং ২৩৭ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। বাকিরা বিবাহিত জিবনে এক বা একাধিকবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতবছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০২০) যৌতুকের কারণে ৯৯ জন নারী শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, ৮৯ জন মৃত্যু বরণ করেছেন এবং ১৮ জন নারী শারীরিক নির্যাতনের পর আত্মহত্যা করেছেন। জাতিসংঘের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ এই সভ্য দেশটিতে ১৯৮০ সাল থেকেই যৌতুক দেয়া বা নেয়া ফৌজদারি অপরাধ, যা ২০১৮ সালে নতুনভাবে প্রণীত যৌতুক নিরোধ আইনের মাধ্যমে জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭২.৬ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর দ্বারা নানা মাত্রার এক বা একাধিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শারীরিক সহিংসতা (৪৯.৬%), মানসিক সহিংসতা (২৮.২৭%) এবং যৌন সহিংসতা (২৭.৩%)। বিবাহিত নারীর উপর স্বামী কর্তৃক যে কোনভাবে সংগঠিত সহিংসতার হার গ্রামাঞ্চলে সর্বাধিক (৭৪.৮%) এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সর্বনিম্ন (৫৪.৪%)। তবে সিটি কর্পোরেশনের বাইরের শহরাঞ্চলে এই হার ৭১.১% যা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় কিছুটা কম।
স্বামীর দ্বারা নানা ধরনের, বিভিন্ন মাত্রায় নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ বিবাহিত নারী (৭২.৭%) কখনও তাঁদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা কাউকে জানায় না। নির্যাতনের বিষয়ে অন্যদের অবহিত না করার পেছনে উল্লেখযোগ্য কারনসমূহ হচ্ছে, ৩৯.৩% নারী এটিকে প্রকাশ করারই প্রয়োজন মনে করেন না। পারিবারিক সম্মানের দিকে তাকিয়ে ১৫.৬% এবং স্বামীর ভয়ে ১২% বিবাহিত নারী নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না। এসবের পাশাপাশি বিষয়টি গোপন রেখে লজ্জা বা বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে চান ৭.৭% নির্যাতিত নারী। মাত্র ৩ শতাংশেরও কম ভুক্তভোগী নারী স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই তথ্যসমূহ উঠে এসেছে বিবিএস পরিচালিত ২০১৫ সালের ঐ সমীক্ষায়।
আমাদের দেশের শহর এবং গ্রামাঞ্চলের ৬৩% পুরুষ একমত হয়েছেন যে, স্ত্রী যদি তাঁর স্বামীর সাথে যৌনতায় বা যৌনমিলনে অস্বীকৃতি জানান, তবে স্ত্রীকে মারধর বা আঘাত করা যেতে পারে। আরও ৬২% পুরুষ বিশ্বাস করেন, এমন অনেক সময় আসে যখন মারধর স্ত্রীদের প্রাপ্য। দেশব্যাপী পরিচালিত এক জরিপের মাধ্যমে গতবছর এই তথ্য প্রকাশ করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ।
জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা মিলে ২০১৩ সালে বাংলাদেশসহ নয়টি দেশের ১০ হাজার পুরুষের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেন, যেখানে দেখা যায় প্রায় অর্ধেক পুরুষ তাঁদের স্ত্রীকে শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতন করেন, এবং এক-চতুর্থাংশ পুরুষ জোরপূর্বক স্ত্রীর সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হন। এক্ষেত্রে এসব দেশের পুরুষেরা শারীরিক সম্পর্কের প্রশ্নে স্ত্রীর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেন না।
স্ত্রীর প্রতি যৌন সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করলেই সামনে চলে আসে বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি। বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনের কোথাও বৈবাহিক ধর্ষণের কথা বলা হয়নি। দেশের ধর্ষণসংশ্লিষ্ট আইনে স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত দেয়া হয়েছে। স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী যদি ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে স্ত্রী ১৩ বছরের ঊর্ধ্বে হলে তা দেশীয় আইনে কখনোই ধর্ষণ বলে বিবেচিত হয় না। এমনকি বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি ধর্মীয় আইন-অনুশাসনেও।
সুতরাং যেসব ভদ্রপল্লীর আশরাফুল মাখলুকাত নারী-পুরুষের বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা পাশ্চাত্যের দাম্পত্য জীবন নিয়ে হাস্যরস করে অর্গাজমের সাময়িক উত্তেজনা নিচ্ছেন, তাঁদের উচিত হবে আপন সমাজ-সংস্কৃতি এবং আশেপাশের পরিবেশ মুক্তমনে অবলোকন করা। নিজ দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় ও নিয়ন্ত্রিত সাংস্কৃতিক বলয়ে নারীদের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করা। আর তা করতে ব্যর্থ হবার আশঙ্কা থাকলে আপাতত মার্কিন সাংবাদিক হেলেন রোলান্ডের বিখ্যাত উক্তিটি পড়ুন- ‘‘যখন দুজন মানুষ বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়, ব্যাপারটি এমন নয় যে তাঁরা একে অপরকে বুঝতে পারে না, এর মানে হলো তাঁরা দুজন দুজনকে বুঝতে শুরু করেছে।’’
ভাবুন, ভাবতে শিখুন, ভাবার চর্চা করুন!
প্রভাত নাজমী, লুন্ড, সুইডেন