সুমিত রায়:
কাল যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু বিতর্ক দেখার পর মনে হলো প্রস্টিটিউশনের লিগালাইজেশনের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বা প্রস্টিটিউশনের লিগালাইজ করার ব্যাপারগুলোকে অনেকেই মনে করছেন প্রস্টিটিউশনের হার্মফুল দিকগুলোকে অস্বীকার করা হচ্ছে, আর প্রস্টিটিউশনকে অন্যান্য সার্ভিসের মতো এক করে বিবেচনা করে একে লিবারাল ফেমিনিজমের ফ্রেমওয়ার্কে একে ক্ষতির বদলে কেবলই স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত করে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এরকম না। প্রস্টিটিউশন নিয়ে এই আলোচনায় যাবার পূর্বে মনে হলো কেবল লিগালাইজেশনের ব্যাপারটা নিয়েই কিছু আলোচনা করা জরুরি। তাই এই লেখাটি।
সমাজের গভীরে এমন কিছু স্রোত থাকে, যা শত আইন আর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থামানো যায়না মাদক, জুয়া, প্রস্টিটিউশন—এগুলো যেন মানব সমাজের এক চিরচেনা, কিন্তু অন্ধকার দিক। রাষ্ট্র যখন দেখে কঠোর শাস্তির ভয় দেখিয়েও, কারাগার ভর্তি করেও এসব স্রোতকে বাগে আনা যাচ্ছে না, উল্টো তা কালোবাজারের চোরাগলিতে ঢুকে আরও ভয়ংকর আর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে, তখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। প্রশ্ন জাগে, তবে কি পথ একটাই? যা দমন করা যায় না, তাকে নিয়ন্ত্রণের জালে বেঁধে ফেলা? এই আপাত স্ববিরোধী কৌশলটিই আধুনিক রাষ্ট্রশাসনের এক জটিল কিন্তু বাস্তববাদী অধ্যায়। এটি কোনো নৈতিক অনুমোদন নয়, বরং বৃহত্তর ক্ষতি এড়ানোর এক প্রায়োগিক চেষ্টা।
হার্ম রিডাকশন ফ্রেমওয়ার্কের ধারণাটা দিয়েই শুরু করছি। যখন কোনো আচরণ বা অভ্যাসকে সমাজ থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন এই নীতি সামনে আসে। অ্যালান মারল্যাট বা কেটি উইটকিউইজের মতো গবেষকরা দেখাচ্ছেন, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা অনেক সময় উল্টো ফল দেয়। তখন মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়—আচরণটি যদি বন্ধ করা না-ই যায়, তবে এর সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলো কীভাবে কমানো যায়? যেমন, মাদক ব্যবহারকারীকে অপরাধী হিসেবে দেখার বদলে একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থী হিসেবে গণ্য করা। নিরাপদ স্থানে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা—এ সবই এই কাঠামোর অংশ। উদ্দেশ্য হলো, অবৈধ ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি (যেমন HIV সংক্রমণ), অপরাধ প্রবণতা, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা। বৈধতা এখানে নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ, যা ব্যবহারকারীকে রাষ্ট্রের নজরদারিতে আনে এবং সাহায্য পাওয়ার পথ খুলে দেয়।
বিশেষভাবে প্রস্টিটিউশনের লিগালাইজেশন নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রস্টিটিউশনকে যখন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও অপরাধ গণ্য করা হয়, তখন তা অন্ধকার জগতে আশ্রয় নেয়। আর এই অন্ধকারই হয়ে ওঠে শোষণ, নির্যাতন আর মানব পাচারের উর্বর ক্ষেত্র। যৌনকর্মীরা যখন আইনি কাঠামোর বাইরে থাকেন, তখন তারা অত্যন্ত প্রান্তিক ও অরক্ষিত হয়ে পড়েন; পুলিশি হয়রানি, দালালদের নির্যাতন, স্বাস্থ্যঝুঁকি—এসব তাদের নিত্যসঙ্গী। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, এই অবৈধতার সুযোগ নিয়ে সেক্স ট্রাফিকাররা জোরপূর্বক বা প্রতারণার মাধ্যমে নারীদের এই পেশায় ঠেলে দেয়, কারণ কর্মীরা তখন আইনি সুরক্ষা চাইতে ভয় পান বা সক্ষম হন না। নিয়ন্ত্রিত বৈধকরণ এই অন্ধকার জগৎকে নিয়ন্ত্রণের আলোয় নিয়ে আসে। যখন যৌনকর্মীরা শ্রমিক হিসেবে আইনি স্বীকৃতি পান, তখন তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হয়। রাষ্ট্র তখন কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যবিধি, বয়সসীমা নির্ধারণ এবং নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কর্মীদের সুরক্ষা দিতে পারে। এতে করে কর্মীদের পক্ষে শোষণ বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা সহজ হয়, যা পাচারকারী বা অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য কমাতে সাহায্য করে। বৈধতা মানেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা নয়, কিন্তু এটি অন্তত সেই অসহায় মানুষগুলোকে রাষ্ট্রের কাছে দৃশ্যমান করে তোলে এবং তাদের শিকার হওয়া থেকে বাঁচানোর একটি প্রাতিষ্ঠানিক পথ খুলে দেয়, বিশেষ করে মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ দমনে যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
আবার অন্যদিকে তাকালে দেখা যায় উপযোগবাদ বা ইউটিলিটারিয়ানিজমের যুক্তি। জেরেমি বেনথাম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো দার্শনিকরা মনে করতেন, রাষ্ট্রের যেকোনো নীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, যদি কোনো ক্ষতিকর বিষয়কে নিষিদ্ধ রাখার ফলে সমাজে অপরাধ, অসুস্থতা, রাষ্ট্রীয় নজরদারির ব্যয়—সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়, আর নিয়ন্ত্রিত বৈধতার মাধ্যমে সেই সামগ্রিক ক্ষতি কমানো যায়, তবে সেটাই হবে যৌক্তিক বা ‘উপকারী’ নীতি। যেমন, গাঁজা বা মদের অবৈধ ব্যবসা থেকে যে অপরাধচক্র বাড়ে, যে পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়, তার চেয়ে নিয়ন্ত্রিত বৈধতা দিয়ে কর আদায় করা এবং ব্যবহারকে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনা—অনেক রাষ্ট্রের কাছে বেশি কল্যাণকর মনে হতে পারে। এখানে নৈতিক আদর্শের চেয়ে বাস্তব ফলাফলের হিসাবটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
এই বাস্তবতার গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের আচরণগত যুক্তিও। গ্যারি বেকার বা কেভিন মারফির মতো অর্থনীতিবিদরা র্যাশনাল এডিকশন থিওরি বা চয়েস থিওরির মাধ্যমে দেখিয়েছেন, মানুষ অনেক সময় ক্ষতিকর জেনেও কোনো আচরণে লিপ্ত হয়, কারণ তারা তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করে। আসক্তিকেও তারা একধরনের যুক্তির কাঠামোতে ফেলেছেন। রাষ্ট্র যখন কোনো কিছু নিষিদ্ধ করে, তখন ব্যবহারের ‘মূল্য’ (Cost) বেড়ে যায়—আইনি ঝুঁকি, কালোবাজারের চড়া দাম, পণ্যের অনিরাপদ মান ইত্যাদি। কিন্তু যদি চাহিদা প্রবল থাকে, মানুষ এই ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না। নিয়ন্ত্রিত বৈধতা এই ঝুঁকি-কাঠামোকে বদলে দেয়। রাষ্ট্র তখন কর, নিয়মকানুন, স্বাস্থ্য সতর্কতার মাধ্যমে ব্যবহারের ‘মূল্য’ নির্ধারণ করে এবং কালোবাজারের আকর্ষণ কমায়। এটা
মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করার একটা অর্থনৈতিক কৌশলও বটে।
সময়ের সাথে সাথে সমাজ যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে নতুন নতুন ঝুঁকির ধারণা তৈরি হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী উলরিখ বেক তার রিস্ক সোসাইটি এর ধারণা দিতে গিয়ে দেখিয়েছেন, আধুনিক সমাজ নিজেই নানা ধরনের প্রযুক্তিগত, পরিবেশগত বা সামাজিক ঝুঁকি তৈরি করে এবং রাষ্ট্রকে সেই ঝুঁকিগুলো ব্যবস্থাপনা করতে হয়। মাদক, অনিয়ন্ত্রিত জুয়া বা অসুরক্ষিত যৌনকর্ম—এগুলোও একধরনের সামাজিক ঝুঁকি। যখন এই ঝুঁকিগুলো সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র বৈধতার মাধ্যমে একে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ দেয়। অর্থাৎ, ঝুঁকিটাকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে আইন ও নীতির আওতায় এনে দৃশ্যমান ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে তোলে। এটা অনেকটা বাঁধ দিয়ে বন্যার জল নিয়ন্ত্রণের মতো—স্রোতকে অস্বীকার না করে, তাকে নির্দিষ্ট পথে চালিত করার চেষ্টা।
শেষ পর্যন্ত, এই কৌশল ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ওপর চাপ কমানোর একটা উপায়ও। মার্ক ক্লেইম্যানের মতো অপরাধবিদরা শাস্তি প্রয়োগে মিতব্যয়িতার (Parsimony in Punishment) কথা বলেছেন। তাদের মতে, সব ধরনের অপরাধ বা বিচ্যুতিকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে গেলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এবং তাতে গুরুতর অপরাধ দমনে মনোযোগ কমে যায়। মাদক ব্যবহারকারী বা ছোটখাটো জুয়াড়িদের জেলে ভরার চেয়ে যদি সেই সম্পদ ও মনোযোগ গুরুতর অপরাধী বা সংগঠিত অপরাধ দমনে ব্যবহার করা যায়, তাহলে সমাজের সার্বিক নিরাপত্তা বাড়ে। তাই অনেক সময় কম ক্ষতিকর বা নিয়ন্ত্রণযোগ্য বিচ্যুতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শাস্তির বদলে নিয়ন্ত্রণ বা চিকিৎসার পথ বেছে নেয়, যা বৈধকরণের মাধ্যমে সহজ হয়।
তাই, এটা স্পষ্ট যে কোনো ক্ষতিকর বিষয়কে বৈধতা দেওয়াটা রাষ্ট্রের দুর্বলতা বা নৈতিক পরাজয় নয়, বরং এটি এক জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার বাস্তবসম্মত ও বহুস্তরীয় কৌশল। এর পেছনে কাজ করে জনস্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদ, অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশ, ক্ষমতা প্রয়োগের আধুনিক কৌশল এবং সর্বোপরি, অনিবার্য বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে বৃহত্তর অকল্যাণ এড়ানোর চেষ্টা। এটা আদর্শ আর বাস্তবের টানাপোড়েনে রাষ্ট্রের এক কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যেখানে লক্ষ্য—ধ্বংস নয়, নিয়ন্ত্রণ।
আরও একটা কথা।
ভাববাদী বা আইডিয়ালিস্ট রাষ্ট্রচিন্তা অনুসারে রাষ্ট্রের কাছে সমাজের একটা আদর্শ প্রায় নিখুঁত ছবি আঁকা থাকে—যেখানে কোনো অন্ধকার নেই, বিচ্যুতি নেই। এই ভাববাদী রাষ্ট্রচিন্তা বা নৈতিকতার বিশুদ্ধতার মোহ অনেক সময় আমাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে যখন রাষ্ট্র কোনো অনিবার্য, কিন্তু ক্ষতিকর বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈধতার পথে হাঁটে, তখন অনেকেই আঁতকে ওঠেন। তাদের মনে হয়, এ যেন অন্যায়কে স্বীকার করে নেওয়া, অপরাধের সাথে আপস করা; যেন বৈধতা দেওয়া মানেই বিষয়টিকে নৈতিকভাবে সঠিক বলে মেনে নেওয়া। কিন্তু এখানেই বাস্তবতার কঠিন পাঠ শুরু হয়। লিগালাইজেশন মানে ক্ষতিকর বিষয়টিকে নৈতিক সার্টিফিকেট দেওয়া নয়; বরং এটা হলো সেই অনিবার্য স্রোতকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণের বাঁধ দেওয়ার এক প্রায়োগিক প্রচেষ্টা। যে ক্ষতিকে নির্মূল করা যাচ্ছে না, তাকে চোখের আড়ালে আরও ভয়ংকর হতে দেওয়ার চেয়ে নিয়ন্ত্রণের আলোয় আনা—এটাই সেই বাস্তববাদ বা রিয়ালিজম। তাই কেবল আদর্শের মাপকাঠিতে সবকিছু বিচার না করে, ভাববাদী রাষ্ট্রচিন্তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে, এই ধূসর বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াটা জরুরি। নইলে আমরা হয়তো নীতির শুদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে বৃহত্তর সামাজিক ক্ষতিকেই আমন্ত্রণ জানাব, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
#IfYouAskUs
#BdFeministThoughts
#WhatAreBdFeministsThinking
#WomanUnite