ফারজানা আকসা জহুরা: অনেক দিন আগে একটি প্রতিবেদন পড়ে ছিলাম, ” জাপানিদের ভিনদেশি জীবনসঙ্গী”। প্রতিবেদনে একজন বিবাহিতা ( প্রিয়াসী ) এক সেকেন্ড না ভেবেই তার স্বামী সম্পর্কে বলেন, ও (স্বামী) ভীষণ কেয়ারিং, আমাদের সময় দেয়, আমাকে নিয়ে, আমার সন্তানকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে।

অন্যজন (নাজিম) তার স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন, কী আর বলবো, ও ( স্ত্রী) তো ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের… চারটা বাচ্চা সামলে, সংসারের শত কাজ যে কেমনে সামলায় তা দেখে আমিও আশ্চর্য হই, ওদের সময় দিতে পারি না, কিছুটা বন্ধু প্রিয় মানুষ আমি, তাই ঘরে ও বাইরে নিয়মিত আড্ডা হয়, কোনো অভিযোগ- অনুযোগ এখনো পাইনি। বলুন, ভালো স্ত্রী না বলে কি উপায় আছে?
দুইজন বিবাহিত মানুষ, দুইজনের কাছেই তাদের জীবনসঙ্গী ভালো, তবে তাদের সঙ্গীটি ভালো হবার কারণটা শুধু ভিন্ন নয়, ভাবনার বিষয়ও বটে! নারীটির কাছে তার জীবনসঙ্গী খুব ভালো মানুষ, কারণ তার স্বামীটি তাদের ব্যাপারে খুব কেয়ারিং, তাকে ও তার বাচ্চাদের সময় দেয়, সংসারের কাজে হেল্প করে, তাদের নিয়ে ঘুরতে যায়, ইত্যাদি। কিন্তু পুরুষটির কাছে তার জীবনসঙ্গী খুব ভালো মানুষ কারণ, তার স্ত্রী একাই ঘর সংসারে সকল কাজ করেন, স্বামী-সংসার নিয়ে তার স্ত্রীর কোনো অভিযোগ নেই, আবার স্বামীর কাছে তার কোনো চাওয়া-পাওয়াও নেই।
প্রতিবেদনটা পড়ে এক ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। যিনি ঘরের কাজে আমার সঙ্গীর সাহায্য করা দেখে প্রায় গর্ব করে বলতেন যে, “তাকে কখনও ঘর-সংসার দেখতে হয়নি, ওসব তার স্ত্রী একাই করতেন! তিনি বাচ্চার ন্যাপকিন পাল্টানো দূরের কথা, বাচ্চাকে ঠিকমতো কোলে নিতেই পারেন না। তার স্ত্রী তার চার ছেলেকে একা একাই মানুষ করেছেন, এর জন্য তাকে কখনও কোনো সাহায্য করতে হয়নি। এমনকি, তিনি যখন বাংলাদেশে ছিলেন, তখন তার স্ত্রী বাচ্চা হওয়ার সময়, সারাদিন ধান সিদ্ধ করে, শ্বশুর-শাশুড়িকে খাওয়া-দাওয়া করানোর পর রান্নাঘরে বসেই বাচ্চা প্রসব করিয়েছেন, তাও একা! আর আজ কালকার যুগের মেয়েরা কিছুই করতে পারে না”!

ভাইটি যখন কথাগুলো বলতেন, তখন তার ভিতর বিন্দুমাত্র অনুতাপ থাকতো না। আমি অবাক হতাম এই ভেবে যে, এই ভাই ২০ বছর ধরে এই আধুনিক বিশ্বে বসবাস করেও মনে করেন, বাচ্চা পালন ও ঘরের কাজ শুধুই নারীদের! আর এই কাজে পুরুষের সাহায্য না করা, বা নারী হয়ে স্বামীর সাহায্য না নেয়া, রীতিমতো গর্বের বিষয়!
আসলে আমরা যতো উন্নত বিশ্বেই থাকি না কেন, যতো আধুনিক আর উচ্চশিক্ষিতই হই না কেন, নারীদের বা ঘরের স্ত্রীদের নিয়ে আমাদের এই হীন মন-মানসিকতা কোনদিন পাল্টাবে না। এখনও আমাদের চিন্তায় সেই নারী ততো ভালো, যেই নারী সবার হুকুম পালন করে, কখনও কোনো কথায় না বলে না, কোনো ব্যাপারে প্রশ্ন করে না। যাদের নিজেদের কোনো চিন্তা বা মতামত থাকে না, সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা যারা লালন-পালন ও চর্চা করে। যারা হবে সহ্যশীল, সংসারী, চুপ চাপ, ধার্মিক, স্বামীর কাছে যার কোনো অভিযোগ বা চাওয়া-পাওয়া থাকবে না, যারা মন-প্রাণ দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করবেন। আর এর অন্যথা হলেই সেইসব নারী সমাজের চোখে বেয়াদব। আর এই বিষয়গুলো তখনই প্রকাশিত হয়, যখন আমাদের সামনে কোনো ব্যতিক্রমি নারীর উপস্থিত হয়। তখনই আমরা সবাই ব্যতিক্রম নারীটির উপর কথার বাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
আর এইরকম বহু ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকেও। এই দেশে আসার এক মাসের মধ্যে আমার প্রথম বাবুটি হয়। তখন আমার সঙ্গীকে ঘরের কাজ ও বাইরের কাজ দুটোই করতে হতো। অসুস্থ শরীরে একা বাচ্চার লালন-পালন করতে আমার খুবই কষ্ট হতো। বলে রাখা ভালো, বিদেশের মাটিতে একা মানে একাই।
এই দেশে আপনি ছুটা বুয়া, বাঁধা বুয়া পাবেন না, আর আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব তেমন না থাকলে খুবই সমস্যায় পড়তে হয়, যা আমাদের ছিলো না। এছাড়া রাস্তায় আমার জন্য কোনো রিকশাও দাঁড়িয়ে থাকে না, কোথাও যেতে হলে এই অসুস্থ শরীরেই প্রচুর হাঁটতে হতো, তাও বাচ্চা নিয়ে। এছাড়াও পরিবেশ ও আবহাওয়ার এতো পার্থক্য, যা মানিয়ে নেয়ার জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন।
যাই হোক, আমার সঙ্গী দীর্ঘদিন বিদেশে একা বসবাস করছে, আর তাই হয়তো ঘরের কাজ করতে তার কোনো সমস্যা ছিল না। যেটুকু সময় সে ঘরে থাকতো, সেই সময়টুকু সে বাচ্চা সামলাতো। মানে বাচ্চাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো, ন্যাপকিন পাল্টানো, সবই করতো। এমনকি আমি যদি কিছু রান্না না করতাম, তাহলে সে রান্না করে আমাকে খাওয়াতো।
আমার সঙ্গীর ঘরের কাজ করা এই দেশের বাঙালীদের চোখে খুব লাগতো। যখনই কেউ বাসায় আসতো, তখনই তারা নানা ভাবে নানা কথা শোনাতো। এক ভাবী আমার সঙ্গীর রান্না করা আর ঘর-সংসারের কাজ করা দেখে আমায় বললেন, স্বামী হলো উপরে রাখার জিনিস… তাকে না কী উপরে রাখতে হয়, তাকে দিয়ে ঘরের কাজ করানো ঠিক না, এতে স্বামীর মন পাওয়া যায় না, তাছাড়া ভালো মেয়েরা স্বামীর কথা শুনে ও তার সেবাযত্ন করে।
আরেক ভাবী প্রায়ই আমাকে বোঝাতেন যে, আমি শুধু পড়াশোনাই করেছি, ঘরের কাজ, বাচ্চা পালন করা, এসব কিছুই শিখিনি, তাদের মা-খালারা তাদের কতো কী শিখিয়েছেন, মেয়ের একমাত্র যোগ্যতা ঘরের কাজে, এতো দূর পড়াশোনা করে মেয়েদের কোনো লাভ নেইl
অনেকে আবার এমন কথাও বলে বেড়িয়েছে যে, আমার সঙ্গীর নাকি উচিৎ হয়নি এতো শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করা, অল্প বয়সী, কম শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলে এমন হতো না, আমি নাকি শিক্ষার গর্বে স্বামীকে সম্মান করি না!
জন্ম থেকে ঢাকা শহরে হয়তো বসবাস করার কারণে আমার এই ধরনের অভিজ্ঞতা ছিল না। যদিও চাকরি করার সময় গ্রামগুলিতে এই ধরনের গল্প শুনেছিলাম । কিন্তু ইউরোপে এসেও এই ধরনের কটু কথা আমায় শুনতে হবে, তা ছিলো আমার কল্পনাতীত!
আসলে সমস্যা হলো আমাদের দেশে সামাজিক চিন্তা ভাবনার। যেখানে মেয়েরা ছোট থেকে ভাবতে শেখে ও তাদের শেখানো হয় যে, “ঘরের কাজ আর বাচ্চা পালনই নারীর একমাত্র কাজ এবং নারীর সংসার জীবনের বড় অস্ত্র। কারণ এই দুটি বিষয়ে যেহেতু ছেলেরা কম বোঝে বা কম আগ্রহী, তাই এই দুটি অস্ত্র দিয়েই তারা তাদের স্বামীদের বা সংসারের পুরুষ সদস্যদের ফাঁদে ফেলে বশ মানাতে পারবেন, বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এতে তাদের খাওয়া-পরা, সামাজিক সম্মান সবই নিশ্চিত। আর তাই তারা এই দুটি অস্ত্র হাতছাড়া করতে রাজি না”l
যদিও অনেক ভাবী গোপনে ঘরের কাজে স্বামীর সাহায্য নেন, কিন্তু তা তারা কখনও স্বীকার করেন না, এতে যদি তাদের ভালো মেয়ের তকমাটা চলে যায় !
ভালো ভাবীরা ভালো নারী তকমা পাবার জন্য বাইরের কোনো কাজও করেন না, উপরন্তু বলেন, বাইরের চাকরি করা তাদের স্বামীদের পচ্ছন্দ না। আর তাদের স্বামীরা বলেন, চাকরি করলে নাকি মেয়েদের চোখ-মুখ ফুটে যায়, তখন বৌ নাকি আর বৌ থাকে না, ‘বেশ্যা’ হয়ে যায়! তাই ভাবীরা সেজেগুজে মাসে মাসে পার্টি করে বেড়ান। এসব পার্টিতে তারা শুধু তাদের সাজসজ্জাই প্রদর্শন করেন না, হরেক রকম খাবার বানিয়ে অতিথিদের বোঝানোর চেষ্টা করেন তারা ঘরের কাজে কতোটা পটু! ১০/১৫ পদের খাবার না দিতে পারলে নাকি তাদের সম্মান থাকে না! এছাড়াও দই-মিষ্টি আর রসমালাই তাদের ঘরে বানানো চাই-ই চাই, যদিও তার চেয়ে ভালো মিষ্টি বাইরে কিনতে পাওয়া যায়! এখানেই শেষ না, কোন ভাবী কী রান্না করলো, কার রান্না কেমন, তা নিয়ে রীতিমতো একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করেন।
অথচ তাদের যদি কখনও প্রশ্ন করেছি যে, ভাবী এই অফিসটা কোথায়, কিংবা ঐ অফিসিয়াল কাজটা কীভাবে করতে হয়, ভাবীদের তখন সগর্বে উত্তর ছিল, আমরা তো এইগুলি করি না, ওসব কাজ আপনার ভাইয়ে করেন।
কখনও যদি জানতে চেয়েছি, কোথায় কোন ডাক্তার বসেন, তখনও তারা বলেছেন, তারা কখনও স্বামী ছাড়া ডাক্তারের কাছে যান না। স্বামীর উপর নির্ভরশীল এই ভাবীরা পোষাকে আর চলনে নিজেদের আধুনিকতাই প্রকাশ করতেন, যদিও চিন্তায় তাদের অবস্থান ছিল আধুনিকতা থেকে হাজার মাইল দূরে।
আমি বলছি না যে ঘরের কাজ করা, সাজসজ্জা করা, রান্না করা, বা বাচ্চা পালন খারাপ কাজ, বা ছোট কাজ , বরং আমি ঘরের কাজগুলিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করি। কিন্তু আমার সমস্যা হলো, নারী বলে কেন আমাকেই ঘরের কাজে পটু হতে হবে? আর আমার সঙ্গী কেন ঘরের কাজে আমাকে সাহায্য করতে পারবে না? অন্যদিকে আমি নিজে কেন বাইরের কোনো কাজ কিংবা অফিসিয়াল কাজগুলি করতে পারবো না? সংসারটা তো দুইজনের, তাই না? তাহলে দুইজন কেন দুইজনকে সাহায্য করবো না? ভালো হতে হলে কি আমাকে “রুপকুমারী হয়ে স্বামীর দাসী হতে হবে”?