পতিতার পরিচয় রাষ্ট্র জানে, খদ্দেরের চেহারা সমাজ ভুলে যায়

ফারদিন ফেরদৌস:

পতিতার অপরাধ, ক্লায়েন্টের পূজা, একপেশে নীতির নাগপাশে নারী; এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে আবার আলাপ হচ্ছে। ফিলানথ্রোপিস্টরা সজ্ঞানে প্রশ্ন তুলছেন, কেন আলো জ্বলে শুধু নারীর গায়ে, ছায়ায় হারিয়ে যায় ক্রেতারা। ক্রয়ের পাপ কার, আর বিক্রয়ের কলঙ্কই বা কার? নারীর শরীর নিষিদ্ধ পেশা হলে পুরুষের ভোগ পবিত্র কেন? আইনের আয়নায় প্রতিবিম্বিত কেন হবে একতরফা প্রতিচ্ছবি!

মানুষের মর্যাদা শুধু একটি ধারণা নয়, এটি একটি নৈতিক দাবি। এই দাবি যখন সমাজের প্রান্তে ঠেলে রাখা কোনো নারী উচ্চারণ করেন, তখন তা ব্যথার এক অদৃশ্য সঙ্গীত হয়ে ওঠে -শোনা যায় না, তবে বাজতে থাকে উচ্চাঙ্গ কারুণ্যতায়।

মানব সমাজে কিছু প্রশ্ন চিরকাল প্রাসঙ্গিক -কাকে আমরা অপরাধী মনে করি? আর কাকে নির্দোষের মুখোশ পরাই? এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে এসেছে বাংলাদেশের নারী সংস্কার আইন প্রণয়নের প্রস্তাবনার মাধ্যমে, যেখানে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার চিন্তা চলছে।

কেউ বলছেন -এটি নারীর অধিকার, কেউ বলছেন -এ এক চূড়ান্ত অবমাননা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই বিতর্কে অধিকাংশের চোখ শুধুই সেই নারীর দিকে, যিনি বিক্রি হচ্ছেন। যিনি কিনছেন, তিনি কোথায়? তিনি দায়মুক্ত—অদৃশ্য এক ‘গ্রাহক’, যাকে ছুঁতে চায় না সমাজ কিংবা রাষ্ট্র।

একজন নারীর পতিতাবৃত্তিতে আসার পেছনে কতগুলো ভাঙা গল্প থাকে, তীক্ষ্ণ কাঁচের টুকরো থাকে। কতগুলো থেমে যাওয়া স্কুলজীবন, কতগুলো অভুক্ত দুপুর, কতগুলো নিপীড়নের রাত। রাষ্ট্র যদি তাঁকে সহানুভূতি দেয়, তবে সেটি দিতে হবে মর্যাদার ভিত্তিতে নয় -পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনার ভিত্তিতে।

ইউরোপের রাষ্ট্র ফ্রান্স অন্তত এই তফাৎটা বুঝেছে। তারা ক্লায়েন্টের ওপর আলো ফেলেছে।
বাংলাদেশ এখনও কেবল নারীর শরীরকে আলোচনার কেন্দ্র করে, অন্যপাশটা অন্ধকারে রেখে চলেছে।
এই আলো-আঁধারির খেলা থামাতে হলে দরকার নৈতিক স্পষ্টতা। পতিতা নয়, সমাজকে প্রশ্ন করতে হবে -ক্লায়েন্ট কারা? এবং কেন?

ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দ্বিচারিতা ফ্রান্স অনেক আগেই চিহ্নিত করেছে। তারা ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল একটি আইন পাশ করে ঘোষণা করেছে -যৌনসেবা গ্রহণকারী ক্লায়েন্টই অপরাধী। আইন অনুযায়ী, প্রথমবার যৌনসেবার বিনিময়ে অর্থ প্রদান করলে ১,৫০০ ইউরো জরিমানা, পুনরাবৃত্তিতে জরিমানা ৩,৭৫০ ইউরো পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়া ক্লায়েন্টদের বাধ্য করা হয় সচেতনতামূলক কর্মশালায় অংশগ্রহণে, যাতে তারা বুঝতে পারেন, একজন মানুষকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করার নৈতিক ভার কতটা গুরুতর।

আর পতিতারা? ফ্রান্স তাঁদের অপরাধী নয়, বরং সহায়তা পাওয়ার অধিকারী মনে করে। এদের জন্য চালু রয়েছে ‘প্রস্থান প্রোগ্রাম’, যার আওতায় ছয় মাসের বাসস্থান পারমিট, আর্থিক সহায়তা, কর্মসংস্থান সহায়তা -এমনকি পুনরুদ্ধারযোগ্য জীবনের সম্ভাবনা থাকে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রস্তাব করছে এই পেশাকে ‘পেশাগত মর্যাদা’ দিয়ে আইনি স্বীকৃতি। অথচ কোথাও নেই ক্লায়েন্টের উল্লেখ। নেই তাঁর দায়ভার, নেই বিচার। নারীর শরীর আবারও দাঁড় করানো হচ্ছে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার বিচারকক্ষে, আর পুরুষের লিপ্সা থেকে রাষ্ট্র সরিয়ে নিচ্ছে দৃষ্টি।

প্রশ্ন হলো -এই স্বীকৃতি কি নারীকে মর্যাদা দেবে, না তার দেহকে ব্যবহারের জন্য আরও বৈধতা দেবে?
এই একপেশে মানবতা এক নতুন ‘সুশীল অমানবিকতা’র জন্ম দিচ্ছে। নারীর পেশাগত স্বাধীনতার নামে আমরা যদি শুধু দেহের বাণিজ্যকে স্বীকৃতি দিই, অথচ যারা সেই বাণিজ্যের গ্রাহক -তাদের দায় এড়িয়ে যাই, তবে তা হবে কেবল একপাক্ষিক নীতিনৈতিকতার উদাহরণ।

সমাজ যদি সত্যিই পরিবর্তন চায়, তবে তাকে প্রশ্ন তুলতে হবে ক্লায়েন্টদের নিয়ে। কেন তাঁরা এই ‘সেবা’ নেন? কেন তাঁরা মনে করেন, টাকার বিনিময়ে একজন মানুষকে ভোগ করা যায়?

যে প্রশ্ন ফ্রান্স করতে পেরেছে, বাংলাদেশ এখনও কেন তা করে না! পতিতাবৃত্তি বন্ধ করা হয়তো কঠিন। কিন্তু নৈতিক স্পষ্টতা অর্জন, দায় ভাগ করে নেওয়া, এবং নারীকে সমান মর্যাদায় দেখতে শেখা—তা অসম্ভব নয়। বাংলাদেশ এখনও কেবল নারীর শরীরকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে, অন্যপাশটা অন্ধকারে রেখেছে। এই আলো-আঁধারির খেলা থামাতে হলে দরকার নৈতিক স্পষ্টতা। পতিতা নয়, সমাজকে প্রশ্ন করতে হবে -খদ্দের কারা? এবং কেন?

তথ্যসূত্র:
• TIME Magazine, April 2016 – “France Passes Law Making It Illegal to Pay for Sex”
• European Court of Human Rights Decision, 2024 – Case on French Prostitution Law
• National Survivor Network – Study on the Impact of the French Prostitution Act

লেখক: সাংবাদিক
২২ এপ্রিল ২০২৫

শেয়ার করুন: