‘সম্পূর্ণ স্বাধীন’ নারী বনাম পুরুষতান্ত্রিক নারী

নাদিয়া ইসলাম:

ধর্ষণ সংক্রান্ত ইস্যুতে বাঙ্গালীর ফেইসবুক আজিজিয়ার চাইতে গরম এখন। তাতে একটা সুবিধা হইতেছে, আমাদের আশেপাশের সম্ভাব্য ধর্ষকদের, ধর্ষকদের স্যাঙ্গাতদের, ধর্ষকামীদের, মর্ষকামীদের, পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ এবং নারীদের, পুরুষতান্ত্রিকতার পা-চাটা তল্পিবাহকদের আমরা চিনা ফেলতেছি। মজার ব্যাপার হইলো, এইসব ধর্ষকামীদের একটা বড় অংশই হইতেছেন নারী। এবং অনেকেই নারীকূলের এহেন বেঈমানী এবং এহেন পুরুষতান্ত্রিকতা মাইনা নিতে না পাইরা বড় বড় শ্বাস ফেইলা বুক চাপড়াইয়া মাতম করতেছেন।

আজকে যেমন এক ফেইসবুক বন্ধুর পোস্টে বেশ কয়েকজন নারী (এবং আশ্চর্যজনকভাবেই তারা সবাই হিজাব করেন) ধর্ষিতদের অভিযোগ দিয়া বলতেছেন, “ঐ ছেলেগুলিকে দোষ দেওয়ার আগে আমি মেয়েগুলিকেই জিজ্ঞাসা করবো তারা অত রাতে বের হয়েছিলো ক্যানো?” “বাঙ্গালী সংস্কৃতি পার্টি করার সংস্কৃতি না!” “যত যাই হোক, মেয়েদের তো সাবধানে থাকা উচিৎ!” “কই আমি তো আমার বাবা বা ভাই ছাড়া কোথাও বের হই না!” “ইসলামের নিয়ম মানলে ধর্ষণ হয় না!” “ছেলেদের সামনে টাইট কাপড় পরে ঐভাবে নিজেকে উপস্থাপনের মানে কী?” “রাতের বেলা একজন মেয়ের রাস্তায় বের হওয়ার দরকার কী?” ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি উনাদের সাথে তর্কে যাই নাই। বুদ্ধিহীনদের সাথে তর্কে যাওয়াও বুদ্ধিহীনতা। তর্ক শুরু হইলে আমি যদি কইতাম “কই, হিজাব পইরাও তনু বা খাদিজা তো ধর্ষণ ঠেকাইতে পারেন নাই!” তখন উনারা কইতেন, উনাদের হিজাব করার স্টাইল ঠিক ছিলো না। হয়তো উনারা ‘শরিয়াহ’ অনুসারে হিজাব করেন নাই। বিভিন্ন রঙ্গের হিজাব লাগাইছেন, তাতে ফুল পাখি লতা পাতার পিন মারছেন, হিজাব কইরাও চোখে কাজল দিছেন, ঠোঁটে লিপস্টিক দিছেন বা হিজাব করলেও নাটক সিনেমা করতে গেছেন, বা হিজাব কইরাও প্রেম করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ যদি অযুহাত দিবেন বা কুতর্ক করবেন বইলা ভাবেন, তাইলে উনারে ঠেকানো আমার বাপের সাধ্য না। আমার বাপের এত তেলও নাই। বেচারার এমনিতেই হাই ব্লাড প্রেশার।

পুরুষতান্ত্রিক বাঙ্গালী মেয়েরা আমারে অবাক করে না। বরং বাঙ্গালী নারীবাদী মেয়ে দেখলেই আমি ইদানিং একটু অবাক হই। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পুরুষতান্ত্রিক মেয়েদের বসবাস। তারা সকল রূপে, সকল স্বাদে, সকল গন্ধে, সকল বর্ণে, সকল দ্রাব্যতায় ঈশ্বরের মত সর্বত্র বিচরণ করেন। তারা শাশুড়ি হইয়া বউ পিটান, মা হইয়া মেয়েরে ঠকান, ভাবী হইয়া ননদরে হিংসা করেন, বন্ধু হইয়া বন্ধুর নামে কুৎসা করেন, বোন হইয়া বোনরে গালি দেন, গৃহকর্ত্রী হইয়া কাজের মাইয়ারে খুন্তি দিয়া ছ্যাঁকা দেন। মাঝেমধ্যে গলা টিপা মাইরাও ফেলেন।

পুরুষতান্ত্রিক মেয়েদের সাইকোএ্যানালিসিস কঠিন কিছু না। সিমোন দ্যা বেভোয়া কইছিলেন, ‘একজন নারী- নারী হিসাবে জন্ম নেন না, তারা নারী হয়ে ওঠেন!’ এই পুরুষতান্ত্রিক নারীরাও নিজেরা বাপের, ভাইয়ের, স্বামীর, ধর্মের, সমাজের শাসনে নিজের অজান্তে নিজের অস্তিত্ব টিকাইতে পুরুষতান্ত্রিক নারীতে পরিণত হইছেন।

পুরুষতান্ত্রিক নারীরা দুই প্রকার। প্রথম প্রকার পুরুষতান্ত্রিক নারীরা শারীরিক বা মানসিক বা অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় বা সামাজিকভাবে নির্যাতিত এবং ব্যক্তিজীবনে বেশিরভাগক্ষেত্রে অসফল। দ্বিতীয় প্রকার পুরুষতান্ত্রিক নারীরা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী এবং একেকজন আপাদমস্তক পুরুষ হইয়া ওঠা শক্তিশালী নারী।

প্রথম প্রকার নারীরা নিজেদের উপর অত্যাচাররে অত্যাচার হিসাবে দেখেন না, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের অধিকার সম্পর্কে জানেন না, তারা নিজেদের পুরুষের অধীন মনে করেন- ভাবেন- এইটাই দুনিয়ার নিয়ম। পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ও সমাজ তাদের শিখাইছেন পবিত্রতার এবং সতীত্বের সংজ্ঞা, পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ও সমাজ তাদের শিখাইছেন ভদ্র এবং লক্ষী মেয়ের সংজ্ঞা, পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ও সমাজ তাদের শিখাইছেন তাদের নির্ধারিত দায়িত্বের লিস্ট, পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ও সমাজ তাদের শিখাইছেন তারা অবলা, তারা ছোট, তাদের যত্ন নিতে হবে, তাদের সাজাইয়া গোছাইয়া সুন্দর কইরা আলমারীর মাথায় তুইলা রাখতে হবে, তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে এবং প্রয়োজনে একটু আধটু শাসনও করতে হবে। একটু আধটু শাসন মারামারি এবং ধর্ষণে গেলেও সেই নিয়া উচ্চবাচ্চ্য করা যাবে না। নিশ্চয় তাদেরই কিছু ভুল ছিলো, নাইলে বড়রা তাদের মারবে ক্যানো, বলেন?

নিশ্চয় দোষটা তাদেরই! সুতরাং নো উচ্চবাচ্য! সুতরাং চুপ থাক্‌ বান্দি! সুতরাং কথা কইলে বাড়ি থিকা বাইর কইরা দেওয়া হবে হারামজাদি! সুতরাং গলা উঁচাইলে ভাত কাপড় বন্ধ মাগী! সুতরাং শব্দ করলে খুন কইরা ফেলবো খানকি! সুতরাং কান্নাকাটি ঘরের বাইরে গেলে তালাক দিয়া বাপের বাড়ি পাঠায়ে দেওয়া হবে হারামির বাচ্চা! সুতরাং মুখে মুখে কথা বললে তোমার বাচ্চা এখানে রেখে তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হবে, ডার্লিং! সুতরাং, চুপ থাকো! সুতরাং, চুপ থাকো! সুতরাং, চুপ থাকো!

নিজের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এইসব নির্যাতনের শিকার হইতে হইতে মেয়েদের পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী মেয়ে হইয়া ওঠায় আমি মেয়েদের দোষ দেই না। তাদের জন্য বরং আমার মায়াই হয়। একজন মেয়ে স্বাধীনতা কী প্রকারে হইতে পারে তা না জাইনাই ভালো মেয়ে হইয়া মুখ বুইজা সংসার কইরা বাচ্চা পয়দা কইরা কানতে কানতে এবং নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের শোধ অন্য মেয়েদের উপর তুইলা মইরা যান, অথচ জানেনই না একলা একলা জার্মানির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অয়েস্টার আইসক্রিম খাওয়ার অভিজ্ঞতা কী, জানেনই না নিজের উপার্জনের টাকা দিয়া প্রথমবার সিনেমা দেখতে যাওয়ার মজা কী, জানেনই না তেরো হাজার ফিট থিকা প্যারাশুট নিয়া লাফ দেওয়ার উত্তেজনা কী, জানেনই না নিজের একলার টাকায় পুরা একটা সংসার টানার সুখ কী, জানেনই না পিএইচডি সার্টেফিকেট হাতে নিজের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দ কী!

পুরুষতান্ত্রিক সব মেয়েরাই যে ঘরের কাজ কইরা দিন কাটান, তা না। পুরুষের ঠিক কইরা দেওয়া গন্ডির ভিতর তারা চাকরিও করেন। পি-এইচ-ডিও করেন। কিন্তু কোনো কিছু নিজ স্বাধীন ইচ্ছায় করার তাদের ক্ষমতা থাকে না। মজার বিষয় হইলো, তারা যে অন্যের ইচ্ছায় জীবন কাটাইতেছেন এই বোধও তাদের নাই। নিজের ক্ষমতাহীনতা সম্পর্কে এতই অজ্ঞান তারা!

দ্বিতীয় প্রকার পুরুষতান্ত্রিক নারীরা প্রচুর ক্ষমতাবান নারী। নিজের অত্যাচারিত শৈশব এবং কৈশোর পরবর্তী হাতে পাওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক ক্ষমতার গর্বে তারা একেকজন স্বৈরাচারী ধর্ষকামী পুরুষতান্ত্রিক পুরুষে রূপান্তরিত হন। ইনারা ডেঞ্জারাস ক্যাটাগরি।

দুই ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মেয়েদের জন্যই আমার মায়া হয়। স্বাধীনতা তো শুধু জার্মানিতে একলা একলা ঘুইরা অয়েস্টার আইসক্রিম খাওয়া না। স্বাধীনতা অর্থ সমাজ ও ধর্মের অদরকারী সকল শৃংখল ভাইঙ্গা পুরুষের ঠিক কইরা দেওয়া নিয়মরে কাঁচকলা দেখাইয়া পুরুষরে সঙ্গী হিসাবে পাশে নিয়া নিজে আরেকজন পুরুষে রূপান্তরিত না হইয়া নিজের নিয়মে নিজের মত কইরা নিজের জীবন চালানো।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র মারফত ‘সম্পূর্ণ’ নারী স্বাধীনতা এখনো দূরের হিসাব, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হওয়া কিছুটা হইলেও নিজ ইচ্ছা এবং ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। আমি হানা মোরের মত কনজারভেটিভভাবে ‘মেয়েরা শুধু মেয়ে’ এই চিন্তা যেমন করি না, মেরি ওউলস্টোনক্রাফ্‌টের মত আমার মেয়েদের পুরুষ হইয়া ওঠার রাডিক্যাল চিন্তাও নাই। আমি মনে করি, স্বাধীনতার পথে একজন মেয়ে তার বায়োলজিক্যাল স্বত্ত্বা অর্থাৎ নারীত্বরে সাথে রাইখাই পুরুষাধিপত্যবাদরে খারিজ কইরাই একজন পুরুষের সমান কাজ ও চিন্তা করার সামর্থ্য এবং অধিকার রাখেন।

একজন ‘সম্পূর্ণভাবে’ স্বাধীন নারী কোনোভাবেই পুরুষতান্ত্রিক হইতে পারেন না। একজন ব্যক্তিস্বাধীন স্বাবলম্বী নারীমাত্রই পুরুষ না হইয়া ওঠা নারীবাদী মানবিক নারী, যিনি অন্য নারীরে এবং তার স্বাধীনতারে খর্ব করেন না।

সুতরাং- সিস্টারস, নিজেদের পুরুষতান্ত্রিকতা আইডেন্টিফাই করতে শিখেন। নিজেরা স্বাধীন হন, অন্যদেরও স্বাধীন হইতে সাহায্য করেন। একেকজন নারীবেশে পুরুষ হইয়া পুরুষের নিয়মে না, বরং নিজের নিয়মে বাঁচেন, পুরুষের শিখাইয়া দেওয়া ‘নারীত্ব’র সংজ্ঞা ফালায়া দিয়া নিজেদের নারীত্বরে উপভোগ করেন, নারী হইয়া উঠেন, মানুষ হইয়া উঠেন। অন্য নারীদেরও সেই নারী হইয়া উঠার রাস্তা দেখায়ে দেন। এবং ভুলেও পুরুষের প্রাচীনতম রাজনৈতিক খেলা ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’এর পাতা ফাঁদে পা দিয়েন না।

শেয়ার করুন: