আতিকা রোমা:
আত্মহত্যা। নিজেকে শেষ করে দেয়া। প্রিয়জনদের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে চলে যাওয়া, প্রচণ্ড অভিমানে। আর কোনদিন ফিরে না আসা। সবার কাছ থেকে, সবকিছু থেকে ইতি টেনে নেয়া, পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়া তোমাদের কারো প্রতি আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই। আমার যা ইচ্ছে আমি তা করতেই পারি। তোমাদের সাথে ভীষণভাবে আড়ি।
বছরের পর বছর এভাবেই হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক অভিমানী মানুষ। আমি তাদের বোকা বলতে নারাজ। তারা অভিমানী। এই অভিমান অনিয়ন্ত্রিত, বাঁধ ভাঙা।

আগে আমরা সেভাবে ঘটনাগুলো জানতে না পারলেও এখন তা জেনে যাই এক মিনিটেই, ফেসবুকের কল্যাণে। চেনা অচেনার ভিড়ে সেই দেখা না দেখা মানুষটির জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই কষ্টের একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় কী বোকাই না ছিল মানুষটি, এভাবে কি চলে যেতে হয়?
হয়। আমরা দেখি আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু যিনি এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, তিনি সব থেকে ভাল জানবেন কেন এমনটা তিনি ঘটালেন। খুব সহজে তা ব্যাখ্যা করে ইতি টানার উপায় নেই। এমন কি শুধু কষ্ট পেয়েও এই দায় এড়ান যাবে না একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে।
তাসমিয়া শান্তা নামের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। দেখলাম কিছুক্ষণ আগে ফেসবুকে। আমি চিনি না, আমার সাথে ফেসবুকেও কোন যোগাযোগ নেই। আজই প্রথম তার প্রোফাইলে গেলাম, দেখতে চাইলাম কেন এমন করল সে। কি সেই কষ্টগুলো যা তাকে এমনটা করতে বাধ্য করলো?
দেখতে গিয়ে যা বুঝলাম তা হলো, সেই একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। একাকিত্ব, ডিপ্রেশন। অবাক হয়ে দেখলাম ‘লাইটার ইয়োথ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন উনি। মানে সামাজিক সংগঠন এবং অনেক মানুষের সাথে তার যোগাযোগও ছিল। কিন্তু এই যোগাযোগগুলো এখন এই মুহূর্তে খুব অর্থহীন মনে হচ্ছে আমার। নিজেকে শান্তার জায়গায় দাঁড় করিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করছি, একটি অল্পবয়সী প্রাণবন্ত মেয়ের কি একজন বন্ধুও ছিল না যাকে সে তার কথাগুলো বলতে পারতো বিশ্বাস করে? না হোক সে প্রেমিক, বন্ধুও কি নেই কেউ? আজ তার দেয়াল লিখনে দেখলাম অনেক ভালো ভালো কথা বলছেন অনেকেই, জানতে চাই কেমন বন্ধু ছিলেন আপনারা? একটুও নির্ভেজাল বিশ্বস্ততা দিতে পারলেন না কেউ??
চারপাশে আসলে সবারই হয়তো এই একই অবস্থা। “মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই, সেই মানুষের ভীরে আমার মনের মানুষ নাই”। এই মনের মানুষ কিন্তু শুধু প্রেমিক না, বরং এমন একজন মানুষ, যাকে মন খুলে ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই সবকিছু বলা যায় এবং এমন একজন মানুষ যিনি সমানুভূতি দিয়ে আপনার কথা শোনেন এবং বিশ্বস্ততার সাথে তা গোপন রাখেন।
ভালোবাসার, নির্ভরতার, বিশ্বস্ততার হাতগুলোর ভীষণ অভাব চারদিকে। আমরা অন্যের অধিকার আদায়ের চেষ্টায় কাজ করি কিন্তু নিজেদের কষ্টের কথাগুলো কারো কাছে মুখ ফুটে বলতে পারি না। দিন শেষে কি ভীষণ একা এক একজন এই ব্যস্ত জীবনে। হাজারে হাজারে বন্ধু আছে কিন্তু নির্ভরতার, নির্ভারের বন্ধুটি কোথাও নেই। কেউ একদিনের বেশী দুইদিন আপনার মানসিক ভার নেবে না। কেউ এসে হাত বাড়িয়ে বলবে না হাতটা ধরো, ভয় পেও না, পাশেই আছি। তা বন্ধু, পরিবার বা প্রেমিক হোক।
আমি নিজে ভীষণ অবসাদগ্রস্ত ছিলাম একটা সময়ে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম মরে যেতে। শ্যামলী ফুটওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছি একটা চলন্ত গাড়ি আসার। কিংবা চলন্ত ট্রেনের জন্য। সেই দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে। ফুরিয়ে গেছে, কারণ আমার মা, আমার আপা এবং এমন কিছু বন্ধু আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছে, সাহস জুগিয়েছে যে এসব চিন্তা আর কখনও কাজ করেনি। চরম ব্যর্থতা থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে এসেছি একটা সময়। জীবনকে নতুন ভাবে এবং খুবই ইতিবাচক ভাবে দেখতে শিখেছি। ভালোবাসতে শিখেছি। এই দেখতে শেখাটা, ভালোবাসতে শেখাটা আসলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আজ নিজেকে খুব সফল মানুষ বলবো না, তবে আমি যে জায়গা থেকে উঠে এসে বর্তমান জীবনযাপন করছি তা আসলে বিজয়েরই।
আমি মনোবিজ্ঞানী নই। মনোবিজ্ঞান আমার বিষয় না। কেন একজন আত্মহত্যা করবে, কেন সে জীবনটাকে ইতিবাচক ভাবে দেখবে না, ইত্যাদি কথা মধ্যেও আমি যাবো না। আমি শুধু ভাবছি, আমরা কি পারি না বিশ্বস্ত বন্ধু হতে?? পারি না বন্ধুর জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলতে “পাশে আছি, ভয় পেও না??” পারি না?