একটি ব্যক্তিগত ওড়না এবং আমি

বিথী হক: বলে নেওয়া ভালো, এটি একটি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বিষয়ক লেখা। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো পোষাকের বিরোধিতা করি না। যার যা পরতে ভালো লাগে সে সেটা পরবে, তাতে কারো বিরোধিতা করার কোন অবকাশ নেই। বড়জোর প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা পোষাকের বিষয়ে প্রত্যেকের মতামত থাকতে পারে, তবে সেটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। যেমন আমি ওড়না জিনিসটা ভীষণ অপছন্দ করি। অপছন্দ করার কারণ আমি নিজেই। আমার কাছে ওড়না একটি বিভীষিকার নাম, আমি যার নাগাল পাই না। যাকে শরীরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পরেও শরীর একে সামলে রাখতে পারে না।

আমি সাধারণত আউটলুক নিয়ে কখনো চিন্তিত থাকি না। আমার মেইক-আপ লাগে না, প্রতিদিন জামা-কাপড় ইস্ত্রী করা লাগে না, ম্যাচিং জুতা লাগে না, এমনকি মাঝেমাঝে চিরুনিও লাগে না। সত্যি বলতে আমার মনে হয়, যতক্ষণ আমি লিপস্টিক, কাজলসহ বিভিন্ন নাম না জানা জিনিসপত্র নিয়ে নিয়ে নিজেকে আকর্ষণীয় করব ততক্ষণে অনেক কাজ করা যায়। কবিতা পড়া যায়, সিনেমা দেখা যায়, গল্প-উপন্যাস পড়া যায়। আমি কখনও তাই সাজগোজের ধারকাছ দিয়েও হাঁটি না। মাঝেমধ্যে বা কখনো কখনো শুধুমাত্র কাজল পরি, তাতে ২ মিনিটের বেশি লাগে না।

তো এত কম সময়ের মালিক হয়ে এত বেশি কাজ সামলাতে গিয়ে আমি দেখতে কেমন, কোন পোষাকে আকর্ষনীয় লাগবে, কেমন সাজলে আমাকে সুন্দর দেখাবে এসব ভাবার বা করার সময় পাই না। পেতেও চাই না। তো যেই আমি এসবের পেছনে আমার মহামূল্যবান সময় বিনিয়োগ করি না, তার কাছে ওড়না ঠিক রাখার জন্য বেছে বেছে সেফটি  পিন লাগানো আমার চারিত্রিক ধরণের মধ্যে পড়ে না। অনেকে সেফটিপিন ছাড়াই সব ধরণের কাপড়-চোপড় সামলাতে পারে, এমনকি ওড়নাও; কিন্তু আমি পারি না। ওড়নার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার হাতে সবসময় কিছু- না কিছু থাকেই।

ওড়না পরলে মনে হয় জোর করে কেউ আমাকে ঢেকে রেখেছে খোলসের ভেতরে, চাইলেই যেখান থেকে বের হওয়া যায় না। তারপর বাসের তেকোনা সরু লোহা, মায়ের পেট থেকে বাচ্চার মতো বের হয়ে আসা কাঁটা, রিকশার চাকা, বেঞ্চের মাথাসহ হেন কিছু নেই যাতে ঝামেলায় জড়াইনি। তাই অনেক আগেই এই বিশাল আলোচিত কাপড়ের টুকরোটিকে জীবন থেকে বিদায় জানিয়েছিলাম।

বিথী হক

বিদায় জানালে হবে কী, ওড়না তো কখনো পিছু ছাড়ে না। ওড়না না পরলে নাকি মেয়েরা উগ্র হয়ে যায়। আবার অনেক জায়গায় উগ্র মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই মোটামুটি বাধ্য হয়ে বা না হয়ে, পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে এই মহামূল্যবান চারিত্রিক শুদ্ধতা নির্ণায়ক বস্তুটিকে গলার সাথে পেঁচিয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবার মত ঝুলি। তারপর রিকশায় উঠলে এদিক ওদিক থেকে শোনা যায় “আপু, আপনার ওড়না ঠিক করেন”। এই হল সাবধানী অসাবধানী ভালো মনের পথচারীদের সতর্কবাণী।

কিন্তু জোরে সোরে বাতাস বইতে থাকলে, আর বেচারা ওড়না তার সমর্থনে বুক থেকে উড়ে এদিক ওদিক গেলেই শুরু হয় আসমান-জমিন কাঁপানো নোংরা কথার ফুলঝুরি। অথচ হবার কথা ছিল উল্টোটি। তাদের দৃষ্টিতে যে ওড়না পরে না, খারাপ হবার কথা তার। কিন্তু যার বুকে ওড়না থাকে তার তো খারাপ মেয়ে হবার কথা নয়। ওড়নাটি তো পরিধানকারী নিজেই সরিয়ে ফেলে উড়তে দিচ্ছে না। উড়তে দিচ্ছে না কিন্তু ওড়না তো পরেছে, সেটা চিন্তা করে হলেও পঁচাগলা সমাজের প্রধান উপকরণ এই মানুষজাতের এতটুকু শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। শ্রদ্ধাশীল যখন সব মানুষের প্রতি এরা হতে পারে না, অন্তত নিজেরা যেসব গুণাবলীকে শ্রদ্ধার সাথে দেখে সেসব গুণাবলীর মানুষকে অন্তত শ্রদ্ধা করতে তো জানা উচিত।

যাই হোক ওড়না যারা পরে না, তারা ওড়না না পরলে কোন কোন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে তা যে কারো চেয়ে অনেক ভালো জানে। তারা তাই সমাজের নোংরা কীটটের কাছ থেকে শ্রদ্ধা চায় না। কারো ফিসফিসানি, নোংরা কথা-বার্তার জবাব কিভাবে দিতে হয় সেটা তারা খুব ভালোভাবেই হৃদয়াঙ্গম করতে পেরেছে। ওড়নাকে কারো চরিত্র বিচারের মানদন্ড হিসেবে ধরে নেওয়ার আগে আরো চিন্তার জায়গা আছে। ওড়না পরে রাস্তায় চলা-ফেরা না করা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলার আগেও শিক্ষিত-অশিক্ষিত দু’শ্রেণীর পুরুষদেরই ভেবে নেওয়া উচিত।

আলাদা প্রত্যেকটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে, ভিন্ন ভিন্ন রুচি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি শাড়ি পরে দৌড়াদৌড়ি করতে পারি। অনেকে হাঁটতেও পারে না। আমি পারি, আমি এতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি জিন্স-শার্টেও খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু ওড়না সম্বলিত সালোয়ার-কামিজের ভেতর আমি আর আমি থাকি না, হয়ে যাই জড় পদার্থ। ফোন রাখার জন্য পকেট খুঁজে পাই না। সালোয়ারের পাতলা কাপড়ে কেবলি মনে হয় এই বুঝি গেল ছিঁড়ে, ওড়নায় মনে হয় এই বুঝি গেল উড়ে। এত বিড়ম্বনা পোহাতে হয় যে পোষাকে সে পোষাক আর যাই হোক আমার পরিধেয় নয়।

সে পোষাকই মানুষের পরা উচিত, যে পোষাকে সে আত্মবিশ্বাসের সাথে হাঁটাচলা করতে পারে, দৌড়াতে পারে এবং সর্বোপরি নিজেকে বাঁচাতে মারামারি পর্যন্ত করতে পারে। এমন পোষাক পরা উচিত নয় যা তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নষ্ট করে কেবলি নির্ভরশীল বানিয়ে ফেলে। নিভৃরশীলতা কর্কট রোগের চেয়েও মারাত্মক, যার চিকিৎসা কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব।

শেয়ার করুন: