বইমেলা

বদরুন নাহার পলী:

– বিথী হলো তোমার? তাড়াতাড়ি চল, নইলে যে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।
– এই যে, চল।
– লিস্ট করেছো তো কার কার বই কিনবে?
– সে তো কবে থেকেই করা!
– রিক্সায় যাবে নাকি?
– ভাল করে হাঁটতেই পার না, আবার রিক্সায় যেতে চাও!
– (মনটা যে উড়তে পারে এখনও।)

– টিএসসির আশেপাশ দিয়ে গেলেই বয়সটা মনে হয় ৩০/৩৫ বছর কমে গেল। ওই ছেলেমেয়েরকে দেখলে নিজেদের কথা মনে পড়ে যায়।
– কার কথা মনে পড়ে? শাপলার কথা নাতো?
– ওর কথাই কি মনে পড়ার কথা না?
– ভুলতে পারোনি আজও, তাই না?
– অপরাধবোধ না থাকলে হয়তো ভুলতে পারতাম।
– তুমি তো কোন অপরাধ করোনি!
– করেছি বইকি! মা বাবার অন্যায় আব্দারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারিনি সেদিন। বিয়ের আসরে শাপলাকে একা ফেলে চলে আসতে হয়েছিল, এ যে কি অসহ্য কষ্ট তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না। অন্যায়কে মেনে নেয়াও তো অন্যায়, তাই না?
– খেসারত তো দিয়েছই। এই ভেবে একটু শান্তি পেতে চেষ্টা করো।
– তোমাকে বিয়ে করা যদি খেসারত দেয়া হয় তাহলে তুমি ভুল বুঝেছ। তোমার সাথেও তো অন্যায় করছি।
– আমি তো ওভাবে দেখি না। যে অবস্থা থেকে তুমি আমাকে আর আমার বাচ্চাটাকে উদ্ধার করেছিলে সেদিন, তা কি কোনদিন ভুলতে পারব? তোমার ভালবাসার চেয়ে আমাদের বেশী প্রয়োজন ছিল একটা নিরাপদ আশ্রয়ের। আজ আর কোনো হিসেব নিকেশ করি না, কী পেলাম আর কী পেতে পারতাম।
– (আমার যে সব হিসেবই বাকী! কোথায় যে শাপলা হারিয়ে গেল! খোঁজার মতো সাহসও করে উঠতে পারিনি আজ পর্যন্ত।)

ভার্সিটি জীবনের সাতটা বছর – প্রতিটি দিন ওরা যেত বইমেলায়। বই আর কত কিনতে পারত। কিছু বই ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পড়ে শেষ করে ফেলতো। দুজনে মিলে কত যে গল্প করতো তারপর। এখন প্রতি বছর বই মেলায় যায় আর শাহেদের চোখ দু’টো নিজের অজান্তেই খুঁজে ফিরে একজনকে। বিথী বোঝে, তাই ফেরার পথে বিভিন্ন রকম গল্প করে আর না বোঝার ভান করে।

– এসে গেছি।
– হুম!
– কোনদিক থেকে হাঁটা শুরু করবে?
– একদিক থেকে শুরু করলেই হয়।
– চল ডান দিক থেকে শুরু করি!
– তোমার বইয়ের লিষ্টটা দেখি, ওটাতে কি লিখে এনেছ কোন্ বই কোন্ স্টলে পাওয়া যাচ্ছে?
– হ্যাঁ, এই নাও।
– সব দেখি নতুন নতুন কবি লেখকদের নাম!
– বইগুলো পড়ে দেখো কত জীবনধর্মী লেখা সব।
– হুম!
– তুমি পরের স্টলে যাও আমি ফোনে কথাটা শেষ করেই আসছি। আস্তে আস্তে হাঁটবে কিন্তু।
– আচ্ছা!

– শাপলা তুমি?
– কে আপনি? চিনতে পারলাম না তো!
– শাহেদ!
– (শাহেদ? নাকি শাহেদের ধ্বংসাবশেষ? চেনাই যাচ্ছে না! ডান পা টা একটু টেনে টেনে হাঁটছে কি?)
– কেমন আছ?
– (তুমি কেমন আছ? এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছি তোমার দেখা পেলে তোমাকে অপমানে অপমানে জর্জরিত করব বলে। আজ যে কিছুই বলতে পারছি না। গলায় কী প্রচণ্ড ব্যথা, কী কষ্ট!)

– শাপলা তুই?
– বিথী?
– তাহলে তুইই শাপলা রহমান, যার লেখার এত ভক্ত আমি?
– আচ্ছা!
– শাহেদ এই হলো শাপলা রহমান, আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী। জানতামই না ও এত বড় লেখক হয়ে গেছে আর আমি ওর ভক্ত। শাপলা, এ হলো শাহেদ, আমার হাসব্যান্ড।
– (বলে কি? বিথীর তো আমার বিয়ে পণ্ড হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাহলে? চেহারা ছবি শান্ত রাখতে হবে। ওদেরকে যেভাবেই হোক এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে হবে। নিজেকে সামলে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।) বিথী, এই নে আমার কয়টা বই। আজ একটু তাড়া আছে, স্টলে আর বসতে পারছি না, চলে যেতে হচ্ছে, অন্যদিন কথা হবে। ভাল থাকিস।
– তুইও ভাল থাকিস।

বদরুন নাহার পলী

স্টলের পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে প্রায় দৌড়ে চলছে শাপলা। কোনদিকে, কতক্ষণ কে জানে! একটু পানি না খেলেই না। বিথীর চোখে শাহেদের জন্য মমতা উপছে পড়ছে! শাপলা ঘেমে অস্থির। একটু বসতে হবে। শাহেদ, আর কোন রাগ নেই তোমার উপর! সুস্থ থেকো তুমি! 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.